১৪ জুলাই ২০২৫, ১৭:১৯

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাবিতে কোট বিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন  © ফাইল ফটো

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফুঁসে ওঠে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আন্দোলন দমন করতে মাঠে নামে পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা দেয়, কোথাও কোথাও চালায় হামলা। তখন শিক্ষার্থীরা বুঝে যান—ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত না করতে পারলে আন্দোলন টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এই বোধ থেকে প্রথম উদ্যোগ নেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেল চারটার দিকে তারা তৎকালীন রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সব নেতাকর্মীকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। রাবি-ই হয় ছাত্রলীগমুক্ত দেশের প্রথম ক্যাম্পাস।

আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থী ও সাবেক সমন্বয়কারীদের সঙ্গে কথা বলে সেই দিনের বিস্তারিত জানা গেছে। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। সেদিনের কর্মসূচি ঘোষণা ছিল বেলা আড়াইটায়, কিন্তু ছাত্রলীগও এক ঘণ্টা ব্যবধানে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয়। পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনকারীরা গোপনে সময় এগিয়ে আনে এবং আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আসতে বলা হয়।

মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর থেকে ২০০–২৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি মিছিল প্রধান গেট ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। ১০০ জনের বেশি পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা বাধা দেয়নি। শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে রড, লাঠিসোটা, পাইপ নিয়ে এসেছিলেন।

ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে হলের শিক্ষার্থীরাও দলে দলে বেরিয়ে আসেন। প্যারিস রোডে মিছিলটি আসার পর বিপরীত দিক থেকে আরও কয়েকশ শিক্ষার্থী এসে এতে যুক্ত হয়। মেয়েদের হলের সামনে আসার পর দেড় হাজারের মতো ছাত্রী মিছিলে অংশ নেন। এরপর মিছিলটি বিজ্ঞান ভবনের পাশ দিয়ে হবিবুর রহমান হল মাঠ পেরিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে আসে। সেখানকার ছাত্রলীগকর্মীদের প্রতিহত করা হয়। তারা ইটপাটকেল খেয়ে পিছু হটে মাদার বখ্শ হলের দিকে সরে যায়।

ততক্ষণে শাহ মখদুম, লতিফ ও আমীর আলী হল থেকেও শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসেন। তাঁরা শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে তাড়া করেন। ফলে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের রাজত্ব ফেলে মোটরসাইকেলে চেপে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। গালিবের পালিয়ে যাওয়ার ১০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তার কক্ষ ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা।

এরপর বিজয় ২৪ হলের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগকর্মীদের রুমেও ভাঙচুর চালানো হয়। পুলিশ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তার কক্ষ ও দপ্তর সেল থেকে শিক্ষার্থীরা তিনটি পিস্তল, ছয়টি রামদা, ১০–১৫টি মদের বোতল, বেশ কয়েকটি দা ও রড উদ্ধার করেন এবং পরে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেন।

সেদিনকার ঘটনাকে স্মরণ করে সাবেক সমন্বয়ক মেশকাত মিশু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মসূচি নস্যাৎ করতে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয়, প্রতিটি হলে বসিয়ে রাখে পর্যবেক্ষক, কয়েকটি হলে তালা দিয়ে দেয় যাতে শিক্ষার্থীরা বের হতে না পারে। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।’ তিনি জানান, তিনি মাদার বখ্শ হলের সামনে গিয়েছিলেন ছাত্রলীগের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে। সেখানেই তিনি গালিবকে সহযোগীদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখেন। কিছু সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী তাঁদের তাড়া করে। গালিব পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

আইন বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৫ জুলাই থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। নির্ধারিত সময় ছিল বিকেল ৩টা, তবে হামলার আশঙ্কায় গোপনে সময় এগিয়ে দুপুর আড়াইটায় কর্মসূচি শুরু হয়।’ মেয়েদের হলের সমন্বয় দায়িত্বে থাকা সানজিদা জানান, তিনি দুপুর ১টা থেকেই মন্নুজান হলে ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেন। তারপর অন্যান্য হলেও গিয়ে শিক্ষার্থীদের জড়ো করেন। প্যারিস রোড হয়ে আসা ছেলেদের মিছিলে মেয়েরাও একত্র হন এবং একসঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেরিয়ে যায় ছাত্রলীগ।

সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ‘১৬ জুলাই আমরা ছাত্রলীগকে রাবি থেকে বিতাড়িত করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাসেও ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। মূলত এই কর্মসূচিই ছিল ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ভিত্তিপ্রস্তর।’ তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালেও ছাত্রলীগ আন্দোলন দমন করেছে। এবার ছাত্রলীগকে সরিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম।’

আরেক সাবেক ফাহিম রেজা বলেন, ‘১৫ জুলাই রাতেই আমরা পরিকল্পনা করি। এক জায়গায় না হয়ে ছেলেদের হল, মেয়েদের হল ও বিনোদপুরে আলাদা আলাদা অবস্থান নিই। ছাত্রলীগ হবিবুর ও জিয়া হলে হামলা করলে, শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দেয় ও রুমগুলো দখলমুক্ত করে।’ তাঁর মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়নের মধ্য দিয়েই ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ চূড়ান্তভাবে মাটিতে মিশিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা।