‘গণরুম, গেস্টরুম মুক্ত ঢাবি দিয়ে গেলাম, তোমরা রক্ষা করিও’ — হলের দেয়ালে আবেগঘন বার্তা
‘গণরুম, গেস্টরুম মুক্ত ঢাবি দিয়ে গেলাম, তোমরা রক্ষা করিও’ শীর্ষক গ্রাফিতিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল এক্সটেনশনের ১০০৭ কক্ষের দেয়ালে আঁকা হয়েছে। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক জোরালো বার্তা নিয়ে এসেছে এটি। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অভিশপ্ত সংস্কৃতিকে প্রতিরোধ করা যায়, গ্রাফিতির স্লোগানটি নতুন করে শিক্ষার্থীদের মনে এমন আত্মোপলব্ধি ও গভীর অনুভূতির সঞ্চার করেছে।
জানা যায়, গ্রাফিতিটি এঁকেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম ব্যাচের অর্থাৎ ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছগির ইবনে ইসমাইল। তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এবং মুহসীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তার এ কাজে সহযোগিতা করেছেন হলটির আরও দুই শিক্ষার্থী। তারা হলেন- একই শিক্ষাবর্ষের ঢাবির স্বাস্থ অর্থনীতি বিভাগের মেহেদী হাসান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদুর রহমান।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম ব্যাচ হলো গণরুম ও গেস্টরুমের শেষ ব্যাচ। এরপর ১০৩ ও ১০৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছেন এবং গেস্টরুমমুক্ত ক্যাম্পাস পেয়েছেন। তাদের আর এই দুই অভিশপ্ত প্রথা মোকাবেলা করতে হয়নি।
গ্রাফিতিটি আঁকা প্রসঙ্গে ছগির ইবনে ইসমাইল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, লেখাটি মূলত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়েই লেখা হয়েছে। যখন এটা লেখা হয় তখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান পরবর্তীতে ক্যাম্পাস গুলোতে আমাদের জুনিয়রা আসতে শুরু করেনি। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমি বিভিন্ন দেয়ালে বেশকিছু গ্রাফিতি এঁকেছি। কারণ, আমার মনে হয়েছে, নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ ও রক্তদানে যেই ইতিহাস তৈরি হয়েছে তা চির ভাস্বর রাখতে কাজ করা উচিত বা কিছু লেখা উচিত। অর্থাৎ- নতুন শিক্ষার্থীদের কাছে ম্যাসেজ পৌঁছানো উচিত। সেই জায়গা থেকেই আমি গ্রাফিতিটা এঁকেছিলাম। কারণ, গেস্টরুম-গনরুম কালচার ফিরে আসা মানে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন যাত্রা ব্যহত হওয়া। গেস্টরুম-গণরুমের মতো মরণব্যধি কালচার শিক্ষার্থীর মেধা, মনন এবং ক্রিয়েটিভিটি ধ্বংস করে দেয়। মেধা বিকাশের জায়গাকে ধ্বংস করে দেয়।
ছগিরের সহপাঠী মেহেদী হাসান ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, আন্দোলন শেষে যখন হলে উঠলাম তখন সবার মধ্যেই ছিল একরাশ আনন্দ ও রুম বদলের ব্যস্ততা। কেউ কিছু লিখছে, স্মৃতির জন্য রেখে যাচ্ছে সবার ইচ্ছেমতো কিছু কথা। এরই মধ্যে ছগির এসে বলল, ‘মেহেদী, একটা কিছু লেখা যায় না?’ তখনই মাথায় এলো এসব বাক্য। ছগিরের হাতের লেখা খুব সুন্দর থাকায় সে তখন এ বাক্যটি দেয়ালে লিখে ফেলে। রুম থেকে বিদায়ের আগে জুনিয়রদের জন্য রেখে গেলাম ছোট্ট একটা বাণী, ভবিষ্যতে হয়তো তারা মেসেজ পাবে এ আশায়।
এদিকে হলটির শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ গ্রাফিতির মূল বার্তাটি স্পষ্ট যে- আর কোনো শিক্ষার্থী যেন গেস্টরুম ও গণরুমের মতো অমানবিক সংস্কৃতির শিকার না হয়। এছাড়া, তারা এখন আর চুপ থাকতে রাজি নয়। তারা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার।
তাদের মতে, এ গ্রাফিতিটি কেবল একটি লেখা নয়, এটি একটি আন্দোলনের প্রতীক। এটি মনে করিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হওয়া উচিত, ভীতিকর পরিবেশের আখড়া নয়। দীর্ঘদিনের এই অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে মুক্তির জন্য কেবল শিক্ষার্থীদের সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আজ, উদযাপনে যত আয়োজন
জানা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে, ছাত্রলীগের নাম করে ক্ষমতার দাপটে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের এক প্রকার দাসে রূপান্তরিত করে রাখা হয়েছিল। এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে গণরুম ও গেস্টরুম কালচার ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা, যা চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে আরও জোরালো হয় এবং এক পর্যায়ে তা বাস্তবে রূপ নেয়।
জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ। এর আগে, শেখ হাসিনা সরকার থাকাকালেই তিনি গেস্টরুম ও গণরুম কালচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। সূর্যসেন হলের গ্রাফিতিটির বার্তা সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গণরুম-গেস্টরুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সব সময়ই ছিল। যে দলই যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারাই এখানে গণরুম-গেস্টরুম প্রতিষ্ঠা করেছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী আমাদের মূল দাবি ছিল, আর কোনো গণরুম-গেস্টরুম থাকবে না। মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা সিট পাবে এবং ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বেই প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা সিট পাবে। এটা আমাদের দাবি ও অঙ্গীকার ছিল।
তবে মোসাদ্দেক আলী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই বৈধ সিট দিতে পারছে না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা প্রভোস্টকে ম্যানেজ করে গণরুমের আপডেটেড ভার্সন আনার চেষ্টা করছে। এভাবেই গণরুম ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রশাসনকে এই ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। সেই সাথে শিক্ষার্থীদেরকেও এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আয়মান তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, দীর্ঘদিন আমরা যে ছাত্রলীগের অত্যাচার সহ্য করেছি, আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী কোনো জুনিয়র সেই নির্যাতনের শিকার হোক। আমরা চাই প্রত্যেকে তার বৈধ সিটে থাকুক।