অভ্যুত্থানের পর ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বই ইস্যুর হার কমেছে ৫৮ শতাংশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার একসময় গবেষণামুখী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তরুণ বুদ্ধিজীবীদের কাছে ছিল জ্ঞানচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রতিবছর প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার নতুন বই যুক্ত হয় গ্রন্থাগারটিতে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই আগ্রহে দেখা দিয়েছে বড় রকমের ভাটা।
সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গত দুই দশকে এই গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যুর হার কমেছে প্রায় ৯৬ শতাংশ। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে—এই দুই সময়ের তুলনায় দেখা গেছে, বই ইস্যুর হার ৫৮ শতাংশ কমে গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, অভ্যুত্থানের আগের সাত মাস (২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মে) এবং পরের সাত মাস (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ) এর তুলনামূলক পরিসংখ্যানে এই নাটকীয় পতনের চিত্র উঠে আসে।
অনেকেই মনে করছেন, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা, ডিজিটাল বই পড়ার প্রবণতা ও চাকরির পড়াশোনায় ঝোঁকের কারণেই এই পরিবর্তন এসেছে। যদিও কেউ কেউ এটাকে স্বাভাবিক বললেও, বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ এটিকে আশঙ্কাজনক প্রবণতা হিসেবে দেখছেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির বই নিয়ে ব্যস্ত। কেউ মূল বই বাদ দিয়ে অনলাইন থেকে ডাউনলোড করা সংক্ষিপ্ত নোট পড়ছে, কেউবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রস্তুতিমূলক কনটেন্টে নির্ভর করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “বিগত কয়েক বছর ধরেই আমি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে একাডেমিক কোনো বই ইস্যু করার প্রয়োজন পড়েনি।”
তাঁর মতো অনেক শিক্ষার্থীই মনে করেন, একাডেমিক পড়া প্রয়োজনীয় হলেও লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে পড়া এখন অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে বই ইস্যুর এ ধরনের পার্থক্য খুবই চমকপ্রদ। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখনও রাজনৈতিকভাবে স্থির হতে পারেনি। অনেকে এখনও অভ্যুত্থানের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থীরা আগের মতো একাডেমিক বইয়ের প্রতি আগ্রহী নয়। কেউ কেউ রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। আগে যারা ভাবত রাজনীতি তাদের জন্য নয়, তারাও এখন সেখানে সম্ভাবনা দেখছে। তাছাড়া অভ্যুত্থানের পরপরই একধরনের ‘উৎসবমুখরতা’ও দেখা গেছে ক্যাম্পাসে—নানা মতের নানা সংগঠন গান, নাচ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সময় ব্যস্ত রেখেছে।”
ড. সামিনা বলেন, “এছাড়াও ডিজিটালাইজেশনের ফলে শিক্ষার্থীরা এখন প্রয়োজনীয় বই অনলাইনেই পেয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় শিক্ষকরাই ক্লাসে প্রয়োজনীয় মেটেরিয়াল দিয়ে দেন। ফলে গ্রন্থাগারে গিয়ে বড় সাইজের একাডেমিক বই সংগ্রহ করা ও বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা এড়াতেই তারা অনলাইনকে বেছে নিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমরা যারা প্রিন্ট বইয়ের যুগে বেড়ে উঠেছি, তাদের দৃষ্টিতে সরাসরি বই পড়ার গুরুত্ব আলাদা। কিন্তু নতুন প্রজন্ম যেহেতু জন্ম থেকেই ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্যস্ত, তাই তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এক্ষেত্রে অনলাইনে বই পড়া মানেই বই বিমুখতা—এই ধারণা সঠিক নয়।”