০৩ মে ২০২৫, ১৯:১৬

ছাত্রদের রাজাকার, ছাত্রীদের হিজাবের কটূক্তিকারী অধ্যাপকের বিচার চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা—অনীহা প্রশাসনের

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়া  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়া। আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের জীববিজ্ঞান অনুষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত ৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের আগে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের তিনি নানাভাবে হেনস্তা করতেন। হিজাব-নিকাব পরিধান করা ছাত্রীদের করতেন কটূক্তি। তাছাড়া তাদের বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতেন তিনি।

এদিকে, জুলাই আন্দোলনকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ড. আজমল। তাছাড়া তিনি আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন ফেসবুকে। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পরও আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে বিভিন্ন উসকানিমূলক কথা ফেসবুকে প্রচার করতেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ওই বিভাগের সব শিক্ষার্থী একযোগে ড. আজমলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন।  এ অবস্থায় তাকে ৪ বছরের জন্য বিভাগের নির্দিষ্ট কিছু ব্যাচের ক্লাস-পরীক্ষার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়। এর আগে আন্দোলন চলাকালে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১৯টি আবেদন (একক ও যৌথভাবে) বিভাগে জমা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাডেমিক কমিটি একমত হলে তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানায়।

আরও পড়ুন: ‘যেখানে যেতেন সেখানেই যৌন হয়রানিতে জড়াতেন’ ড. মিজান, ব্যবস্থা নিতে ঢাবির গড়িমসি

অন্যদিকে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন, চার্জ গঠন এবং তাকে বিভাগের সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টা মতামত দিলেও ৯ মাস পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিন্ডিকেটের সভায় রহস্যজনকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদিও সবশেষ সিন্ডিকেটের কয়েকটি সভায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এজেন্ডায় রয়েছে।

বর্তমানে বিভাগটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়া বিরুদ্ধে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা রহস্যজনক বলছেন। তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকষণ করেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, সাম্প্রতিক সিন্ডিকেটের সভায় ডাকসু ও সাত কলেজসহ কিছু ইস্যু নিয়ে আলোচনা করায় সময় লাগছে। ফলে অনেক এজেন্ডা শেষ করা হয় না। এজন্য সময় লেগেছে শিক্ষকদের এসব অভিযোগগুলো তুলতে।

প্রয়োজনে দ্রুত কয়েকটি সিন্ডিকেট সভা ডেকে এজেন্ডভুক্ত বিষয়গুলো তুলা হবে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও প্রশাসনের গণমাধ্যম মুখপত্র অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সিন্ডিকেটের সভায় এজেন্ডা এতো বেশি যে সময় লেগেছে সবগুলো শেষ করতে। এজন্য কিছু পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে। আমরা জরুরি ইস্যুগুলো আগে শেষ করার চেষ্টা করি এবং অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের পর বাকি এজেন্ডাগুলো উঠছে না। এসময় তিনি দ্রুত কয়েকটি সিন্ডিকেট সভা করে এসব এজেন্ডাগুলো তুলা হবে বলে জানান

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়ায় বিষয়ে সিন্ডিকেটের এজেন্ডায় বলা হয়, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সকল শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার' বলে অভিহিত করার শিক্ষার্থীদের আনীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে সকল অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা ও তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয় বিবেচনা।

সিন্ডিকেট এজেন্ডায় বলা হয়, ‘গত ২০ আগস্টে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির সভায় যেসব সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে-ভর্তি সেশন ১ম বর্ষ (২০২২-২০২৩), ২য় বর্ষ (২০২১-২০২২), ৩য় বর্ষ (২০২০-২০২১) ও ৪র্থ বর্ষ (২০১৯-২০২০) এর শিক্ষার্থীদের আবেদন ও অ্যাকাডেমিক কমিটিতে আলোচনার প্রেক্ষিতে উল্লিখিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়াকে সকল একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করেছে; ছাত্র-ছাত্রীদের আবেদন ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়ার মৌখিক দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তাছাড়া তদন্ত কমিটি গঠন, চার্জ গঠন এবং তাকে বিভাগের সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য আইন উপদেষ্টা মতামত দিয়েছেন।’

আরও পড়ুন: মদ্যপ অবস্থায় ক্লাসে যেতেন ঢাবির অধ্যাপক!

জানা যায়, আন্দোলন চলাকালে বিভাগের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১৯টি আবেদন (একক ও যৌথভাবে) জমা হয়েছিল। কোন অভিযোগ পুরো ব্যাচ, আবার এককভাবে ভুক্তভোগী কোনো শিক্ষার্থী আবার কয়েকজন শিক্ষার্থী যৌথভাবে এসব অভিযোগ লিখিতভাবে বিভাগে জমা দিয়েছিল।

এক ব্যাচের সব শিক্ষার্থীদের এক অভিযোগে বলা হয়, অধ্যাপক আজমল হোসেন ভূঁইয়া চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সকল শিক্ষার্থীদের 'রাজাকার' বলে অভিহিত করে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানোসহ শিক্ষার্থীদের উপর চলমান ন্যাক্কারজনক হামলা ও গণহত্যার সমর্থনে বিভিন্ন উসকানিমূলক কথা ফেসবুকে প্রচার করেছেন। এছাড়া ওনার কিছু ফেসবুক পোস্ট আমাদের সকলের ধর্মীয় ও জাতিগত ভিত্তিকে সরাসরি আঘাত করেছে, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের বিব্রত করেছে যা একজন শিক্ষকের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরিতাপের বিষয় এই যে, উনার সেসব পোস্টে কোন শিক্ষার্থী যৌক্তিক কোন মন্তব্য করলে তিনি তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন।

এতে আরও বলা হয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় শ্রেণিকক্ষে এমনকি পরীক্ষার হলে নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক নিয়ে হেনস্তা করেছেন, বিশেষ করে নিকাব পরিধান নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ক্লাসে নারী শিক্ষার্থী এবং নারী শিক্ষকদের বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন যা আমাদের জন্য লজ্জা ও লাঞ্ছনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি পবিত্র কুরআন নিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বিভিন্ন অবান্তর মন্তব্য করেছেন যা আমাদের মনকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। শিক্ষার্থীরা ওনার বিতর্কিত মতের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদেরকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া, 'জেলের ভাত খাওয়ানো', ভিত্তিহীনভাবে শিক্ষার্থীদের জঙ্গি ট্যাগ দেয়া সহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি প্রদান করেছেন। এ বিষয়ে জানার পর আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা ও দুঃশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে।

‘তাছাড়া ক্লাসে উনি খুবই অনিয়মিত; সময়মতো সিলেবাস কমপ্লিট করেন না এবং সারা বছর ল্যাব না করিয়ে পরীক্ষার আগে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক চাপের মধ্যে রেখে যাচ্ছেতাইভাবে ল্যাব করিয়ে থাকেন। এসব কারণের পরিপ্রেক্ষিতে, সকল শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রয়াসে ওনাকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এবং ফেসবুকে প্রচার করলে উনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফোন করে এবং মেসেজ করে বিভিন্ন ধরনের হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে এবং ডিপার্টমেন্টে ক্লাসরুমে ফিরতে শঙ্কিত বোধ করছে।’

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজমল হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির সভা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। কিন্তু গড়িমসি করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, অভিযোগ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

ড. আজমলের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আনা অভিযোগগুলো হল, তিনি নিয়মিত ক্লাস, ল্যাব ও পরীক্ষা নেন না, এক ক্লাসে একাধিক উপস্থিতি দেয়, অতিরিক্ত সময় ধরে রোল কল করেন, পরীক্ষায় স্বজনপ্রীতি করেন এবং তা নিজ মুখে শিকার করেন, ভাইবাতে স্বজনপ্রীতি এবং ফেসভ্যালু করে নম্বর দেন, পর্দাশীল মেয়েদের ক্লাসে ও ভাইভাতে হেনস্তা করেন, মেয়েদেরকে ছেলেদের চেয়ে হেয় করেন, একাধিক মেয়ে ও ছেলেকে অভিযোগ দেওয়ার পর রাত ১২টার পর কল দেন।

বিভাগের এক শিক্ষার্থী আলাদাভাবে অভিযোগপত্রে লেখেন, ‘আমাদের শিক্ষক আজমল হোসেন ভূঁইয়া ক্লাসে প্রায়ই নিকাব পরার কারণে শিক্ষার্থীদের কটূক্তি করেন। উনি ক্লাসে অনেক অনিয়মিত আসেন। ক্লাসে কোনো প্রশ্ন করা হলে অপমান করেন। এসব ঘটনা অপমানজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-অনুসারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’

আন্দোলনে অংশ নেওয়া ওই বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোটা আন্দোলন চলাকালে ১৪ জুলাই ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে যখন প্রকম্পিত হয় ঢাবি, তখন এই শিক্ষক ফেসবুকের স্টোরিতে আমাদেরকে রাজাকার বলে গালি দিয়েছিলেন। এরপর তোপের মুখে তিনি সেটি ডিলেট করে দেন। এছাড়াও আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা করতেন তিনি। সর্বশেষ ১ আগস্ট তিনি আমাদেরকে আন্দোলন থেকে সরে আসতে আওয়ামী লীগের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয়, ৫  আগেস্টর পর সবাই আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা ফেসবুকে লেখালেখি বন্ধ রাখলেও ড. আজমল তার বিতর্কিত লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। পরে আন্দোলনে নামলে বিভাগ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরের সঙ্গে একাধিকবার দেখাও করি। তারা আশ্বাস দিলেও কোনো ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেয়নি।

ওই বিভাগের এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর আমরা সবাই অ্যাকাডেমিক কমিটির সভায় বসে ড. আজমলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে বলি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রশাসন তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই মনে হচ্ছে, প্রশাসন নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

জানতে চাইলে বিভাগের অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষক বর্তমানে বিভাগে আংশিক ক্লাস নিচ্ছেন। উনার যে অভিযোগ তা অনেক আগেই প্রশাসনকে অবহিত করেছি। সম্ভবত সিন্ডিকেটের সভায় এজেন্ডাভুক্তও হয়েছে।’