ছাত্রীদের আবাসনে ঢাবিতে নতুন তিনটি হল, ৩টি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা
দায়িত্ব নেওয়ার ৪ মাসের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনে ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসন যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রীদের আর কোনো আবাসন সংকট থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, এই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নারীবান্ধব করে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন ছাত্রীরা।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য পাঁচটি হল এবং দুটি হোস্টেল রয়েছে। হলের আকৃতি বিবেচনায় রোকেয়া হল ছাড়া অন্য হল/হোস্টেলগুলো ছেলেদের তুলনায় অনেক ছোট। এছাড়া এসব হলগুলোতে রয়েছে নানা সমস্যা। অন্যদিকে, ঢাবিতে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যায় প্রায় সমান। ফলে অনেক ছাত্রী আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ নিয়ে একাধিকবার আন্দোলনেও নেমেছেন তারা। সর্বশেষ সোমবার (৬ জানুয়ারি) শতভাগ আবাসনের দাবিতে ভিসি বাসভবনের সামনে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীরা।
এই কর্মসূচির মধ্যে ছাত্রীদের নতুন দু’টি হল এবং তিনটি বহুতল ভবন নির্মাণে ২ হাজার ৮৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলেছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৮৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রস্তাবিত ৪টি ছাত্রী হলের বর্ধিত ভবন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনের বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই প্রকল্পে শাহনেওয়াজ হোস্টেল ভেঙ্গে ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি ছাত্রী হল নির্মাণ, ১০ তলা ও ৬ তলাবিশিষ্ট শামসুন নাহার হলের দু’টি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের বিদ্যমান স্টাফ কোয়ার্টার বি এবং ডি ভবন ভেঙ্গে ১১ তলা ও ৮ তলাবিশিষ্ট দু’টি ভবনের সমন্বয়ে একটি ছাত্রী হল নির্মাণ এবং ১০ তলাবিশিষ্ট কুয়েত মৈত্রী হলের সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্প অনুমোদিত হলে প্রায় ৩ হাজার ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে।
এছাড়া, চীন সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় ২৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হল নির্মাণ প্রকল্পটি’ বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মি. ইয়াও ওয়েন সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রী হল নির্মাণে সহযোগিতার ব্যাপারে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন ছাত্রী হলে প্রায় ৫০০ বাঙ্ক বেড স্থাপন করে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বচ্ছ পদ্ধতি ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ১ম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ব্যতিক্রমী ঘটনা। আবাসিক সংকটের মতো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত একটি জটিল সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। ইউজিসি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বন্ধু রাষ্ট্র, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকল অংশীজনকে নিয়ে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে আবাসন সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশা করছে।
এছাড়া, বিশ্ব ব্যাংকের হিট প্রজেক্টের (হায়ার এডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন) আওতায় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবাসন বৃত্তি চালুর বিষয়টিও বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে যেসব ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হবে, তারা এই বৃত্তির আওতায় আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আবাসন সংকট নিরসনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সাইমা হক বিদিশা সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সময়ের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক বিষয়। ছাত্রীদের আবাসন সংকট দূর করার বিষয়টিকে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখছি এবং যত দ্রুত সম্ভব আমরা এর সমাধান করার চেষ্টা করছি। নতুন হল তৈরির বিষয়েও আমরা বহু জায়গায় কথা বলেছি এবং কিছু জায়গা থেকে ইতিবাচক সাড়াও পাচ্ছি।
তিনি বলেন, আশা করি খুব দ্রুতই আমরা হল নির্মাণ করতে পারবো। বর্তমানে অস্থায়ী সমাধান হিসেবে আমরা হলগুলোতে বাঙ্ক বেড স্থাপন করছি ফলে অন্তত কিছু শিক্ষার্থীকে যেন থাকার জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়।
জান্নাতুন নাঈম নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলেন, ক্যাম্পাসের বাইরের পরিবেশ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ। বিশেষ করে গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য হলে আবাসনের ব্যবস্থা না থাকলে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এজন্য নতুন হল নির্মানের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নারীবান্ধব করে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।
ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেয়া আরও যত পদক্ষেপ
রোকেয়া হলে আবাসিক হওয়ার জন্য ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ৯০০ ছাত্রী আবেদন করেছেন। এর মধ্যে সর্বমোট ৫৭০ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়। ১ম কলে ৩৫০ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়। ২য় কলে ২২০ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়।
শামসুন নাহার হলে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সংযুক্ত ৬১২জন ছাত্রীর মধ্যে ১ম কলে ২৩ জন এবং বিশেষ বিবেচনায় (প্রয়োজনের ভিত্তিতে) ৩৬ জনসহ সর্বমোট ৫৯ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়। ইতিমধ্যে ২য় কল দেয়া হয়েছে, যেখানে অপেক্ষমাণ আরও ১০০ জন ছাত্রীকে সিট দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৩১ জনকে ১ সপ্তাহের মধ্যে সিট দেয়া হবে। এছাড়া, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ২০২২-২০২৩ সেশনসহ অন্যান্য সেশনের সর্বমোট ১৪২ জনকে সিট প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলে সিটের জন্য আবেদনকারী ২৯৩ জন ছাত্রীর মধ্যে ১৯৪ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সিট প্রাপ্তির জন্য সাক্ষাৎকারে অনুপস্থিত ছিলেন ৪১ জন। ২০১৮-২০১৯ সেশনের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আরও ৫৮ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে।
কবি সুফিয়া কামাল হলে ২০২৩-২০২৪ সেশনে সকল শিক্ষাবর্ষের মোট ৯৫২ জন ছাত্রী সিট বরাদ্দের জন্য আবেদন করে। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৯১ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আরও ১৫ জনকে সিট দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে। ২০১৮-২০১৯ সেশন এর সিট খালি হওয়া সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে সিট দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সিট বরাদ্দের জন্য আবেদনকারী ২০৫ জন ছাত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন ১৯৫ জন। এর মধ্যে ১৩৫ জনকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি মাসে বরাদ্দ দেয়া হবে আরও ২০ জনকে। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিটের জন্য আবেদনকারী ২০৫ জনের মধ্যে ১৬৪ জন ছাত্রীকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রীদের মাস্টার্স শেষ হলে আরও সিট খালি হবে এবং সেগুলো বরাদ্দ দেয়া হবে।