অন্তবর্তীকালীন সরকারকে কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়া দরকার: চবি প্রো-ভিসি
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তর করে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংষ্কারের জন্য কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়ার আহবান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট মিলনায়তনে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি) আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা নয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক মুক্ত সংলাপে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসীর প্রতি তিনি এ আহবান জানান।
এসময় তিনি জুলাই বিপ্লবে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
চবি উপ-উপাচার্য বলেন, অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বা মূল ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পর ৯টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি এবং বাস্তবায়নও হয়নি। সরকার বা দায়িত্বশীলরা শুধু দিন গোনে, কখন সময় শেষ হবে, রিপোর্ট জমা দিবে এবং তা বস্তাবন্দি করবে। আসলে এ দেশটাকে কিছু দেওয়ার জন্য সহজে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না।
তিনি আরও বলেন, সকল দুর্নীতি তদন্তে ও সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষ দরকার। অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে উল্লিখিত সুপারিশ বাস্তবায়ন ও জনসম্মুখে তা প্রকাশে সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নির্ধারিত রাজনীতিবিদদের হাতে চলে গিয়েছিল, যার কারণে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আমরা আর ব্যাংক লুট চাই না, দুর্নীতি দমনে শুদ্ধাচার চাই, চাই যথাযথভাবে সংস্কার কার্যকর করার মাধ্যমে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। এ ব্যাপারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানান। একইসাথে তিনি অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ৩ বছর ক্ষমতায় থেকে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচন আয়োজনের আহবান জানান। তিনি নতুন বাংলাদেশকে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে জাতির প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সসদ্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হককে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বোধগম্য ও প্রাঞ্জল ভাষায় শ্বেতপত্র নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ জানান।
মুক্ত সংলাপে মূল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিসিআরএসবিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. এ. কে. এম. মাহফুজ পারভেজ (মাহফুজ পারভেজ) এর সভাপতিত্বে মুক্ত সংলাপে নিধার্রিত প্যানেল আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোঃ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী, চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও চবি শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. বেগম ইসমত আরা হক। চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের সঞ্চালনায় মুক্ত সংলাপে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সভাপতি ও চবি তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার প্রশাসক ড. মোঃ শহীদুল হক।
অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক বলেন, শ্বেতপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে ২৮ ধরনের দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। তিনি পেশকৃত রিপোর্টের দ্রুত বাস্তবায়ন ও জাতিকে জানাতে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার জন্য বর্তমান সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ২০২২ সালে সরকারের বিভিন্ন আর্থিক খাতে ২২ হাজারেরও অধিক অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে। দেশ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। সবাই দুর্নীতির কৌশল শিখে গেছে। পাবলিক ফান্ডের দায়ভার না নেয়া, আগে তথ্য দেয়া, তথ্য লুকানো ও হঠাৎ ডকুমেন্ট লাগবে বলে বিনিয়োগকারীদের বিপদে ফেলা ইত্যাদি নানা উপায় দুর্নীতি করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ দুর্নীতিতে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত। তারপরই রাজনীতিবিদদের অবস্থান।
প্রফেসর এনামুল হক বলেন, কৃষি খামার করে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। যারা প্রকৃত হকদার, সে সকল কৃষক ও গরীব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সময় মাস্টার প্লানও বদলানো হয়েছে। পণ্যের দাম বাড়িয়ে কমিশন বাণিজ্য করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশটাকে বদলাতে চাইলে সবাইকে নিয়েই বদলাতে হবে। সিস্টেম সংশোধন করতে হবে। ডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ালেও দুর্নীতি কমানো যায়।
তিনি আরও বলেন, ৫০ হাজার ট্রাক্টর আনা হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য এ ট্রাক্টর আনা হয়েছিল সে দরিদ্র চাষীরা তা পায়নি। দেশের এমপি, মন্ত্রীরা চাষী নাম দিয়ে তা নামে-বেনামে গ্রহণ করেছে। টাকা লোপাটের ৪৫ শতাংশ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পকেটে গেছে। আইসিটিতে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু তা দেখা যায়নি। দুর্নীতি দমন করতে নিচ থেকে ধরতে হবে। দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে গবেষকরা যত চিন্তা করবেন, দেশের জন্য তত মঙ্গল হবে।
এই সময় আইআইইউসির সাবেক উপাচার্য প্রফেসর কে এম গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, দুর্নীতি করিনি, করবো না, কাউকে করতেও দিবো না। এভাবেই আমাদের সকলকে শপথ নিতে হবে।
শ্বেতপত্র নিয়ে আজকের সংলাপ যথেষ্ট নয় চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে কমিটির সকল সদস্যকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবার আসতে হবে। এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, শ্বেতপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এর সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন চান। তিনি বলেন, বিগত সরকারের দলীয় নেতারা বিভিন্ন সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। এখন শুধুমাত্র সাইনবোর্ড পাল্টানো হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজি রয়েই গেছে। এর পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে। তিনি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী চেতনা ধরে রাখতে রাজনৈতিক, আইনগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন।
প্যানেল আলোচক চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা একটা সুন্দর স্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে দমন-নিপীড়ন করেছিল বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার। এ ফ্যাসিবাদী দানব যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য ছাত্রসহ যারা রক্ত দিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি পালানোর পর এদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি অনেক ধরনের হয়েছে কিন্তু বিদেশে নিজের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানোর দুর্নীতি শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। এমন দুর্নীতি কি মানুষ করতে পারে?
এসময় তিনি দশটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং বর্তমান সরকারকে তাড়াহুড়া না করে সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরীর আহ্বান জানান। এজন্য তিনি কমপক্ষে তিন বছর সময় দেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন বিগত সরকারের আমলে দেশের শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে। এটা জাতির কাছে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরও বলেন বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার শেষ পর্যন্ত এদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
প্যানেল আলোচক চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোঃ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, 'এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্ট এবং সুপারিশ প্রদান করছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন চান তিনি। তিনি বলেন, এখনো অনেক বড় বড় কর্মকর্তা পদ ধরে আছেন, তাদেরকেও ধরতে হবে। তিনি বর্তমান সরকারকে সময় দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিপ্লবী সরকার ছাড়া এত সংস্কার করা খুবই কঠিন হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করতে হবে। তিনি সকল দুর্নীতির তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। একইসাথে বিপ্লবের মূল চেতনা বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্যানেল আলোচক প্রফেসর ড. বেগম ইসমত আরা হক বলেন, নতুন বাংলাদেশ অর্জনের পর ৪০০ পৃষ্ঠায় ২৮টি বিষয়ে বিগত সরকারের দুর্নীতির চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র জাতির সম্মুখে প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংষ্কার কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশ আরও সংকটে পড়বে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট, চাঁদাবাজি হচ্ছে। সরকারকে অতিসত্বর কঠোর হস্তে এগুলো বন্ধ করতে হবে।
মুক্ত সংলাপের সঞ্চালক ও চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, বিগত সরকার ডাটা ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়কে আড়াল করেছে। সরকার প্রদত্ত ডাটা এক, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম।
মুক্ত সংলাপে অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান, চবি আইকিউএসির অতিরিক্ত পরিচালক প্রফেসর ড. মোঃ শাহাদাত হোসেন, চবি প্রীতিলতা হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাসমত আলী, চবি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম, চবি রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল এবং মোহাম্মদ হাসান।