২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:২০

তিন বন্ধুর মৃত্যু ও দু’জনের বেঁচে ফেরার মুহূর্ত যেন ট্র্যাজেডি সিনেমা

বা থেকে নিহত মোজাম্মেল হোসেন নাঈম, মোস্তাকিম রহমান মাহিন এবং জোবায়ের আলম সাকিব।  © টিডিসি ফটো

সকাল সোয়া ১০টা। চোখে-মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস। কথা ছিল একটু পরেই বাস গন্তব্যে পৌঁছে যাবে; এরপর শুরু আনন্দ-উল্লাস-উৎসব-হইচই। কিন্তু কে জানত? মিনিট দশেক পরেই সেই উচ্ছ্বাস রূপ নিতে যাচ্ছে বিষাদে-করুণ পরিণতিতে! 

শনিবার (২৩ নভেম্বর) গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনায় ইতোমধ্যেই জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। 

নিহত হওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন- ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়ের আলম সাকিব (২২), মোজাম্মেল হোসেন নাঈম (২৪) এবং একই বিভাগের মোস্তাকিম রহমান মাহিন (২২)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আইপিই বিভাগের আরও অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী। তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

কী হয়েছিল ওই সময়?

কথা হয় বাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিউল আলম মুন্নার সাথে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, মর্মান্তিক এই ঘটনার সূত্রপাত হয় বাস থেকে নামতে গিয়ে। পাশাপাশি একজনকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারাণ তিনজন। তবে বেঁচেও ফিরেছেন দু’জন। আহতরা সবাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের শিক্ষার্থী।

সামিউল আলম মুন্না বলেন, ‘প্রথমে বাস থেকে নামতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন এক শিক্ষার্থী। পরে তাকে বাঁচাতে গিয়ে জোবায়ের আলম সাকিব নিচে পড়ে যান। সেখানে সাকিবের মুখ আটকে গেলে আর কোনোভাবেই তাকে ছাড়ানো যায়নি। কিন্তু ততক্ষণে বেচে যান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া সেই শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে সাকিবকে বাঁচাতে অন্য সহপাঠীদের সাথে ছুটে আসেন নিহত হওয়া মোজাম্মেল হোসেন নাঈমও। 

কিন্তু এবার নাঈমের সাথে আসা শিক্ষার্থী পুনরায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন এটা বুঝতে পেরে ওই শিক্ষার্থীকে লাথি মেরে দরজার বাইরে ফেলে দেন নাঈম। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া সেই শিক্ষার্থী বাইরে পড়ে বাঁচতে পারলেও এবার নাঈমের হাত আটকে যায় দরজার হাতলের সঙ্গে। সহপাঠীরা শত চেষ্টা করলেও দরজা থেকে নাঈমকে আর ছাড়ানো সম্ভব হয়নি। সেখানেই প্রাণ হারান মোজাম্মেল হোসেন নাঈম। একইভাবে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিতে গেলে পথেই প্রাণ হারান মোস্তাকিম রহমান মাহিন।

শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী চায়না প্রজেক্টের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত অন্য শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘শেষের বাসটি সড়কের পাশের ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বাস থেকে ধোয়া বের হতে থাকলে ছাত্ররা চিৎকার শুরু করেন। আমরা তাদের চিৎকার শুনে বাসের কাছে যাই। এ সময় তিন জন ছাত্র বাস থেকে নেমে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের একজনের মৃত্যু হয়। অপর দুই জনকে শুকনো বাঁশ দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করি।’

স্থানীয় বাসিন্দা আফসার উদ্দিন (৭০) জানান, বোর্ড বাজার এলাকায় আইইউটির ৪৬০ জন শিক্ষার্থী ‘মাটির মায়া’ রিসোর্টে ছয়টি বিআরটিসি দোতলা বাস এবং তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিকে আসেন। তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে পৌঁছানোমাত্র সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়া ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইনে একটি বাস (নং ঢাকা মেট্রো ব-১৫৭০৩৮) বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে দুই ছাত্রের মৃত্যু হয়। আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কারও হাত, কারও পা, কারও মুখ ঝলসে যায়।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক জাকিউল ইসলাম জানান, মোজাম্মেল হোসেন নাঈম, মোস্তাকিম রহমান মাহিন ও জোবায়ের আলম সাকিবকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আরও কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন মণ্ডল জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।

এ ঘটনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পিকনিক বাসের সঙ্গে বিদ্যুতের তার লেগে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ক্যাম্পাস থেকে আমি বেরিয়ে পড়েছি। আহতদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিক্যালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেডিকেলে গেলে বিস্তারিত বলা যাবে।’

তদন্ত কমিটি গঠন

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) তিন শিক্ষার্থী নিহত ও ১৫ জন আহতের ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও পল্লী বিদ্যুৎ তিন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলাকে দুষছেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা খাতুনকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটিতে পুলিশ, পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদেরও রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। শনিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন তদন্ত কমিটির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।