২১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৫

‘বীজের অঙ্কুরোদগম ও উৎপাদন হার বাড়াচ্ছে প্লাজমা টেকনোলজি’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার  © টিডিসি

প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে বীজের অঙ্কুরোদগম ও উৎপাদন হার অধিক হারে বৃদ্ধি পায় বলে দাবি করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগে অবস্থিত ‘প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাবের’ গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান কৃষিজ শস্য যেমন: ধান, গম, আলু, বেগুন ও পালং শাকে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হার, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং ফসলের রোগবালাই দমনে ভূমিকা রেখেছে।

ল্যাব সূত্রে জানা যায়, প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র গবেষণাগার প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাব। এটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে যেখানে প্লাজমার প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন সাধনে কাজ করে থাকে। এটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। 

গবেষকদের মতে, পদার্থের চারটি অবস্থা। আমাদের চারপাশের বস্তুগুলো সাধারণত কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। প্লাজমাকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলা হয়। প্লাজমায় অবস্থায় সাধারণত: প্রায় সমানসংখ্যক ধ্বনাত্মক চার্জযুক্ত আয়ন ও ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন থাকে।

প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগ পদ্ধতির উদ্ভাবক ড. তালুকদার বলেন, একক তত্ত্বাবধানে ল্যাব থেকে প্লাজমা টেকনোলজি কৃষি গবেষণায় প্রয়োগের প্রথম সফলতা আসে ২০১৫ সালে। উক্ত গবেষণার প্রথম গবেষক ছিলেন ড. নেপাল চন্দ্র রায়। পরবর্তীকালে ড. তালুকদার ও কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে উক্ত গবেষণাগারে কৃষি ক্ষেত্রে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্লাজমা পাওয়ার সোর্স যেমন: গ্লাইডিং আর্ক ডিসচার্জ প্লাজমা, ডাইলেক্ট্রিক ব্যারিয়ার ডিসচার্জ প্লাজমা, গ্লো ডিসচার্জ প্লাজমা ইত্যাদি তৈরি করেন। এ প্লাজমা সোর্সসমূহ সফলভাবে ব্যবহার করে শস্যের বীজ ট্রিটমেন্ট ও প্লাজমা সক্রিয় পানি প্রয়োগের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম হার, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং রোগবালাই দমনে ভূমিকা রেখেছে। 

গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান বীজের অংকুরোদগম হার ৭৫ শতাংশ যেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে ২১ শতাংশ বাড়ে অর্থাৎ অংকুরোদগম বেড়ে ৯৬ শতাংশ হয়। একইভাবে গম ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশ, বেগুন ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ এবং পালং-শাক ৭০ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত অংকুরোদগম হার বাড়ে। অন্যদিকে, এ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বীজের পরিমাণও কম লাগে একইসাথে উৎপাদন হারও অনেক বেশি বাড়ে এবং উৎপাদন সময়ও ১০-২০ শতাংশ কম লাগে।

এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ধান বীজের পরিমাণ ২,৮৭,৫০০ মেট্রিক টন প্রয়োজন হয় (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে), সেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে ২,৪১,৫০০ মেট্রিক টন বীজ প্রয়োজন হবে অর্থাৎ ৪৬,০০০ মেট্রিক টন বীজ কম লাগবে। একইভাবে গম বীজের ক্ষেত্রে ১,০০,০০০ মেট্রিক টনের স্থানে ৮৫,০০০ মেট্রিক টন এবং বেগুন বীজের ক্ষেত্রে ২৫,০০০ কেজির স্থানে ২২,০০০ কেজির প্রয়োজন হবে।

সবশেষে, গবেষণায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ১১৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছিল ৩৭,৬০,৮০০ মেট্রিক টন (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে)। সেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে ৪৩,৮৭,৮০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন সম্ভব হবে অর্থাৎ ৬,২৭,০০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। একইভাবে গম উৎপাদন ১০,৯৯,০০০ মেট্রিক টন থেকে ১২,৩৪,০০০ মেট্রিক টন, বেগুন উৎপাদন ৫,০৭,০০০ থেকে ৬,১৮,০০০ মেট্রিক টন, পালংশাক ৫৮,০০০ থেকে ৮৯,০০০ মেট্রিক টন এবং আলু ৯৮,৮৭,০০০ থেকে ১,১২,৮৭০০০ মেট্রিক টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। 

উল্লিখিত গবেষণা প্রবন্ধসমূহ Springer, Elsevier, Institute of Physics জার্নালসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাসমূহের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

প্লাজমা টেকনোলজি সম্পর্কে ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার বলেন, ‘প্লাজমা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা’ এ কথা সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা এক টুকরা বরফ দিয়ে উদাহরণ দিতে পারি। বরফ পানির কঠিন অবস্থা বা প্রথম অবস্থা। বরফকে যদি আমরা তাপ শক্তি দিতে থাকি তাহলে বরফের অণুগুলোর মধ্যে যে বন্ধন রয়েছে তা দুর্বল হয়ে যাবে এবং একসময় বরফ গলে পানিতে পরিণত হবে। এখানে স্বাভাবিক পানি হলো দ্বিতীয় অবস্থা বা তরল অবস্থা। পানিকে যদি আবার তাপশক্তি প্রয়োগ করা হয় তাহলে পানি বাষ্পে পরিণত হবে। বাষ্প হলো পানির তৃতীয় অবস্থা বা গ্যাসীয় অবস্থা। এখন যদি আমরা আবার বাষ্পকে আরও উত্তপ্ত করতে থাকি তাহলে বাষ্পে যে নিরপেক্ষ পানির অণু রয়েছে তা আর নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকবে না। অণুর ভেতর যে পরমাণু থাকে, সেই পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা যে ইলেকট্রন রয়েছে, তা যথেষ্ট উত্তাপের কারণে কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসবে। ফলে ইলেকট্রন, আয়ন ও নিরপেক্ষ অণু (বা পরমাণু) সংমিশ্রিত একটি গ্যাস তৈরি হবে। অর্থাৎ শর্ত সাপেক্ষে এই আয়নিত গ্যাসকেই প্লাজমা স্টেট, বা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলা হয়ে থাকে।

এ পদ্ধতির উদ্ভাবক ড. মামুনুর দাবি করেন, বিশ্বে আমাদের ল্যাবই সর্বপ্রথম যেখানে কৃষিক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে শস্যের উৎপাদন হার বাড়ানো নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এর আগে একটা বা দুইটা কাজ হয়েছিল সেটি ল্যাব বেইসড ছিল। এ গবেষণায় গ্লাইডিং আর্ক ডিসচার্জ প্লাজমা সোর্সের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোডদ্বয়ের মাঝে হাইভোল্টেজ প্রয়োগ করে প্লাজমা তৈরি করা হয়। এতে গমবীজ ট্রিটমেন্ট করে বীজের অংকুরোদগম ৯৫-১০০%, ফসলের উৎপাদন ২০% বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ডাইলেক্ট্রিক ব্যারিয়ার ডিসচার্জ প্লাজমা সোর্সের মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য যেমন মাষকলাই বীজ ট্রিটমেন্ট করে বীজের অংকুরোদগম ৮৫-৯০%, ফসলের উৎপাদন ৩৭% এবং ক্লোরোফিল, প্রোটিন ও সুগারের মাত্রা বৃদ্ধিতে সফলভাবে কাজ করেছে। গ্লো ডিসচার্জ প্লাজমা সোর্সের মাধ্যমে কৃষিজ ফসল যেমন ধান ট্রিটমেন্ট করে বীজের অঙ্কুরোদগম ৯৫-১০০%, ফসলের বিকাশ ও উৎপাদন হার ১৭% বৃদ্ধিতে সফলভাবে কাজ করেছে। প্লাজমা সক্রিয় পানি সোর্সের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোডদ্বয়ের মধ্যে হাইভোল্টেজ প্রয়োগে পানিতে প্লাজমা তৈরি করে রিএক্টিভ স্পেসিস (হাইড্রক্সিল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ওজোন, নাইট্রেট, নাইট্রাইট) তৈরি হয় যা ফসলের উৎপাদন হার ও রোগবালাই দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ থেকে কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে ড. মামুনুর রশিদ বলেন, 'আমি ভবিষ্যতে মানুষের জন্য কী রেখে যাব সে আত্মতুষ্টির জায়গা থেকেই কৃষি গবেষণায় গবেষণা করতে আসা। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সার্বিক সহযোগিতা করছে।

সবশেষে সরকারের প্রতি আবেদন করে এ গবেষক বলেন, 'আমার একার পক্ষে তো সবকিছু কাজ করা সম্ভব নয়। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা করলে পদ্ধতিটি কৃষক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। যদি সরকারের যথাযথ মন্ত্রণালয় যদি এগিয়ে আসে তাহলে, আমার গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজাইন করে যন্ত্রপাতি তৈরিতে সহযোগিতা করব। আমি বিশ্বাস করি যে, প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে শস্যবীজের অংকুরোদগম হার বৃদ্ধি ও ফসল উৎপাদনে বড় সাফল্য আসবে এবং কৃষক তথা দেশের অনেক বেশি উপকার হবে।'