২০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৭

মা-বাবার আয় বন্ধ, ঋণ চেয়ে খোলা চিঠি ঢাবি ছাত্রের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষায় মেরিট পজিশন ছিল ওপরের দিকে। চান্স পাওয়ার পর মাকে বলতেন, ‘আম্মু, আমি ঢাকাই যাই, তোমাকে আর মাঠে যেতে দেব না। আমি টাকা পাঠাবো। তুমি শুধু বাড়িতে থাকবে, কোনো কাজ করতে হবে না।’ তবে ‘কঠিন বিভাগে’ ভর্তি হওয়ায় দ্বিতীয়বর্ষে এসেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই মেধাবী ছাত্র। এ পরিস্থিতিতে পরিবারের এবং নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য সহজশর্তে ঋণ চেয়েছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্র  নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রোববার (২০ অক্টোবর) দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছেন, এখনও কেউ সহযোগিতা করেননি। তবে বিষয়টি জানার পর কয়েকজন বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন।  

নিজের অসহায়ত্বের কথা বিস্তারিত তুলে ধরে খোলা চিঠি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্র। চিঠিটি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে প্রকাশের অনুমতিও দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ঢাকায় আসার পর পরিস্থিতি আর বাস্তবতাকে আরও কঠোর হতে দেখলাম। প্রথমবর্ষে আমি কিছু টিউশন করি ও কোচিংয়ে কাজ করি। তাতে মোটামুটি বাড়িতেও কিছু টাকা দিতে পারতাম (আম্মু তখনও মাঠে কাজ করতো)। আর আমারও টেনেটুনে চলে যেতো।

আমি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী (ছেলে)। পরিবারের বড় ছেলে। আমার বাবা দীর্ঘ ২৫ বছর মৃগী রোগে আক্রান্ত, তিনি পরিবারের তেমন কোনো কাজই করতে পারেন না। আমাদের বাড়িও এক প্রান্তিক গ্রামে। আম্মু এ দীর্ঘ ২৫ বছর আমাদের সংসার চালাচ্ছেন, তার পেশা হিসেবে যেগুলো উল্লেখ করা সম্ভব তারমধ্যে অন্যতম শিম, কাঁচা মরিচ, কালাই (কলাই), সবজি উত্তোলন করা, মানুষের ধানের কাজে সহযোগিতা করা ইত্যাদি। যাদের বাসা পল্লীগ্রামে, তারা জেনে থাকবেন- গ্রামে কিছু কপালপোড়া নারী এসব কাজ করেন। 

আম্মুকে ছোট বয়স থেকে মাঠে মাঠে পুরুষের মতো কাজ করে বেড়াতে দেখছি, আর বাবাকে অসুস্থ থাকতে। ছোট থাকতে আমিও মায়ের সাথে মাঠে মাঠে কাঁচা মরিচ আর কালাই তুলতাম। মনে পড়ে, সকাল ১০টায় ব্রাকে পড়তে যেতে হতো, তাই ভোর থেকে ৯টা পর্যন্ত মরিচ তুলতাম। তারপর ভাত খেয়ে ১০টার ক্লাসে যেতাম। আমার একটা ছোট ভাই আছে, সে এখন মায়ের সঙ্গে কাজ করে। সে খুব মেধাবী ছেলে, পড়াশোনায় খুব ভালো। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকে মানুষের জমিতে জোন (কামলা) দিতাম। একাদশে ওঠার পর থেকে টিউশনিও যুুক্ত হয় আমার পেশায়। 

তিনি আরো লিখেছেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর আম্মুকে বলতাম, ‘আম্মু আমি ঢাকাই যাই, তোমাকে আর মাঠে যেতে দেব না। আমি টাকা পাঠাবো, তুমি শুধু বাড়িতে থাকবে কোন কাজ করতে হবে না।’ ঢাকায় আসার পর পরিস্থিতি আর বাস্তবতাকে আরও কঠোর হতে দেখলাম। প্রথমবর্ষে আমি কিছু টিউশনি করি ও কোচিংয়ে কাজ করি। তাতে মোটামুটি বাড়িতেও কিছু টাকা দিতে পারতাম, (আম্মু তখনও মাঠে কাজ করতো) আর আমারও টেনেটুনে চলে যেতো।

আমার ছোট ভাই এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে, আমি নিজেই আম্মুকে বলি যে, ওর লেখাপড়ার খরচ আর বিদ্যুৎ বিল প্রতিমাসে আমিই দেব। সেটা আমি এখনও দিই। কিন্তু সমস্যা হলো, এবারের ভারি বৃষ্টিতে মরিচের সিজনের সব গাছ মারা গেছে (আমাদের এলাকায়)। মাঠে ও বাড়িতে এমন কোন কাজ নেই, যা আমার মা করতে পারবেন। আমি কিছুমাস পরিবারের ধান, চাল, মাছ ও বাজার কিনে দিয়েছি, কিন্তু আমার একার পক্ষে পরিবার ও নিজেকে চালানো অসম্ভব।

আমার মেরিট পজিশন শুরুর দিকে থাকায় আমি একটি কঠিন ডিপার্টমেন্টে (সবাই বলেন) ভর্তি হই, যেখানে টিকে থাকতেও যথেষ্ট পড়াশোনা প্রয়োজন। মূল বিষয়টি হলো: আম্মু আর গ্রামে থেকে টাকা উপার্জনের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। আম্মু গরু-ছাগল পালনে অনেকটা দক্ষ ও কর্মঠ। আমার ছোট ভাইও যথেষ্ট সহযোহিতা করতে পারবেন গরু-ছাগল পালনের কাজে। কোনো ভাই/ভাইয়েরা বা কোনো সংগঠন যদি আর্থিক সহযোগিতা করেন অথবা কিছুটা দীর্ঘ সময়ের জন্য গরু-ছাগল কিনতে টাকা দেন, তাহলে আমার পরিবারের জন্য খুবই উপকার হয় (প্রয়োজনে মুনাফা দিতে রাজি আছি আমরা)।

আরো পড়ুন: ঢাবির বিশেষ মাইগ্রেশনের আবেদন আজ থেকে, বেড়েছে শূন্য আসন

আপনার (বিনিয়োগ করা) টাকা যেভাবে ফেরত দিতে চাই: অনেকেই ব্যাংকে কিছু টাকা জমিয়ে রাখেন বা ইনভেস্ট করতে চান। আপনি যদি আমার পরিবারের গরু-ছাগল কিনতে টাকা দিতে চান তাহলে, আপনাকে কিছু দিনের মধ্যেই আমি (টিউশনের বেতন থেকে) আপনার প্রথম বছরের মুনাফার টাকা পরিশোধ করে দেব। আপনি দ্বিতীয় বছরের মুনাফার টাকা পাবেন বছরের শেষে (চেষ্টা করবো দ্বিতীয় বছরেই আপনার আসল ও মুনাফা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে, যদি কোন সমস্যায় পড়ি তাহলে তৃতীয় বছরে আপনার টাকা পরিশোধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবো)। আপনি নিজেও সুদের অর্থনীতি থেকে বাঁচতে পারবেন ও আমার অনেকটা উপকার হবে।

ঢাবি ছাত্র বলেছেন, আপনি নিজেও আপনার শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন। মুনাফা আলোচনা করে ঠিক করতে চাই। যেহেতু আমাদের পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট খারাপ, আপনি চেষ্টা করবেন যতটা কম নিতে পারেন অথবা বিনা মুনাফায় সহযোগিতা করলে খুবই উপকৃত হবো। আর কেউ যদি কোনভাবে আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেন, তাহলে আমি আম্মুকে ও পরিবারকে একটু শান্তিতে হয়তো রাখতে পারব। 

তিনি লিখেছে, আম্মু খারাপ অবস্থায় আছেন, আবার বাবাও দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ অসুস্থ। তিনিই শুধু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারবেন। আমি আমার পরিবারকে একটু ভালো রাখতে চাই। কিন্তু সেটি আমার একার পক্ষে ও বর্তমানের এ পরিস্থিতিতে অসম্ভব (একটা ছেলের জন্য খুবই অসহায় অবস্থার বর্ণনা এটি)। কেউ যদি আমার পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারেন, তাহলে বিকাশ/নগদে পাঠাতে পারেন। আমি প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি নিয়ে দেখা করতে পারবো।