‘তোমার জায়গায় আরেকটা নাম বসিয়ে দেব’, ছাত্রলীগ কর্মীকে ছাত্রদল নেতা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১০১ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা করেন শাখা ছাত্রদলের এক নেতা। এই মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে মামলার বাদী মোহাম্মদ আহ্সান হাবিব ও আরেক ছাত্রদল নেতা হাসিবুল ইসলাম হাসিবের কথোপকথনের দুইটি কল রেকর্ড গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।
তবে রেকর্ডের বিষয়কে এডিট বলে দাবি করেছেন ছাত্রদল নেতা আহসান হাবিব। বিষয়টি অস্বীকার করলেও হাসিবুল ইসলাম হাসিব স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, জামসেদ সবুজ নামে ছাত্রলীগের এক নেতাকে বাঁচাতে আহসান নামে ছাত্রলীগের একজন ফোন করেছিল। তবে আহসান ছাত্রলীগের কোন পদে রয়েছেন, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানাননি। হাবিব বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং হাসিব বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জিয়া সাইবার ফোর্সের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মাদ আহসান হাবিব বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। তবে মামলা করার পরপরই অভিযোগ উঠে, গত দেড়-দুই বছর আগে ক্যাম্পাস ত্যাগ করা অনেক ছাত্রলীগ নেতাকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে ছাত্রদল নেতা মোহাম্মাদ আহসান হাবিবের ২ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের কল রেকর্ডে আহসান হাবিবকে বলতে শোনা যায়, ‘আসামি তো অনেকগুলো। তোমার জায়গায় আরেকটা নাম বসিয়ে দেব। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। দলের দিক দেখে লাভ নাই। তুমি নিজে বাঁচো আগে। একটা মামলা খেয়ে গেলে কেউ দেখবে না। একটা পলিটিক্যাল মামলা ১০/১৫ বছর চলে।’ এ সময় ফোনের অপর পাশে থাকা ছাত্রলীগ কর্মীকে রুনু-কিবরিয়ার কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠাতে বলেন ছাত্রদলের এই নেতা।’
২ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের কল রেকর্ডে হাসিবুল ইসলাম হাসিব ছাত্রলীগের ওই নেতাকে বলেন, ‘শুনেন এখন আপনাদের (ছাত্রলীগ) সব থেকে বড় শত্রু কে জানেন? জবাবে ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, কে ভাই? হাসিব বলেন, কে বড় শত্রু বলেন তো? ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, এ বিষয়ে আমার আইডিয়া নেই ভাই। হাসিব বলেন- সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থী। এরা হচ্ছে শিবির। সাধারণ শিক্ষার্থী মানেই শিবির। তারা কিন্তু আপনাকে ছাড় দেবে না। আমাদের মামলার লিস্ট দেখছেন? জবাবে ছাত্রলীগ নেতা বলেন- জ্বি ভাই দেখলাম। ফোনের অপর পাশ থেকে হাসিব বলেন, আমাদের মামলা এখনো এন্ট্রি হয়নি, কাল হবে। আমরা তো একটা মামলা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন আরেকটা মামলা করবে। লিস্ট তো দেখেছেনই। এ লিস্ট অনুযায়ী আরেকটা মামলা হবে। যেটা হল প্রশাসন করবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের রাজনীতিতে গ্রুপিংয়ের কথা উল্লেখ করে হাসিব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নেতাকে বলেও লাভ হবে না। আমাদের একটা গ্রুপ আছে। রাজনীতিতে একটা গ্রুপিং আছে। ছাত্রলীগ নেতা বলেন, অবশ্যই জ্বি ভাই। হাসিব বলেন, আপনি মনে হয় জানেন না। আপনি যদি আবিরকে বলেন, এখন আবির যার সঙ্গে রাজনীতি করে তাকে দিয়েও যদি বলানো হয় লাভ নাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সর্বোচ্চ নেতা কে? আহ্বায়ক রাহি ভাই। উনিও যদি আমাকে মানা করে মামলাটা করো না তাও লাভ হবে না। ছাত্রলীগ নেতা বলেন, জ্বি ভাই। হাসিব বলেন, আমরা এন্টি রাজনীতি করি।
সভাপতি-সেক্রেটারির এন্টি রাজনীতি করি ক্যাম্পাসে। ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ভাই বুঝতে পারছি। হাসিব বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নেই। আমরা যেটা করবো সেটাই। তবে আমি একটু আপনার বিষয়ে কথাবার্তা বলি।’
এ সময় হাসিব প্রশ্ন করে আরো বলেন, ‘আপনার সেশন কত ছিল? রুনু কিবরিয়া কমিটির কোন পদে ছিলেন? জবাবে ছাত্রলীগ নেতা বলেন, না ভাই আমি পদে ছিলাম না। এরপর হাসিব বলেন, আপনি ফোন দিয়েছেন। আপনার সোহরাওয়ার্দী হলে আবার সভাপতি নিয়াজ আছে। নিয়াজ আসলে আবার আমার ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই। সেও ফোন দিচ্ছে। আপনারা তো বুঝেন। আমি নাম বাদ দিতে বললে বলবে আমি দালাল। আমি টাকা খেয়ে একাজ করেছি। তো এটা আমি কৌশলে একটু আলোচনা করি। আলোচনা করে কল দিবো ভাই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ফোনের ওপাশ থেকে ছাত্রলীগ নেতা বলেন, জ্বি ভাই আপনার কথা শুনেছি।’
ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি অস্বীকার করে আহসান হাবিব বলেন, ‘রেকর্ডিংটা এডিট করা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
বিষয়টি স্বীকার করে রাবি শাখা জিয়া সাইবার ফোর্সের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম হাসিব বলেন, ‘কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কোনো কথা বলা হয়নি। কারো কাছে কোনো টাকা-পয়সা চাইনি। আমি যতটুকু পেরেছি ছাত্রলীগের ছেলেপেলেদের সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। যারা রানিং ছাত্র আছে, তারা যেন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, সে চেষ্টা করেছি। তবে আমি সহযোগিতার বিনিময়ে কারো কাছে টাকা দাবি করিনি।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, ‘এই মামলা সম্পর্কে আমরা কেউ দলীয়ভাবে অবগত নই, এটা আগেও আপনাদের জানিয়েছি। এখন কল রেকর্ড ভয়েস বিভিন্ন সফটওয়্যারে নকল করা সম্ভব। আর ভয়েসে তার সঙ্গে মিল আমরা পাচ্ছি না।’
হাসিবের কল রেকর্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সে কোন পরিপ্রেক্ষিতে এটি বলেছে সেটা আমার বোধগম্য নয়। সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে থেকে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমরা কখনোই অন্য কোনো সংগঠন নিয়ে মন্তব্য করতে আগ্রহী নই এবং এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর প্রথম পরিচয় সাধারণ শিক্ষার্থী। দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে আমরা কাউকে আলাদা চোখে দেখি না।
তিনি আরো বলেন, ‘রাবি ছাত্রদলের পদধারী কেউ কোনো বিষয়ে মন্তব্য করলে সেটি আমরা সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে যেই শিক্ষার্থী আমাদের দলের (রাবি ছাত্রদল) কোনো পদে বা দায়িত্বে নেই সেহেতু এটা তার ব্যক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সকল মত ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সুতরাং এখানে খণ্ডিত বক্তব্য নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির সুযোগ নেই। দলীয় শৃঙ্খলা অনুযায়ী সংগঠনের আহবায়ক, সদস্য সচিব ও দপ্তর সম্পাদকের বাইরে যেকোনো বক্তব্য বা বিবৃতির দায় ব্যক্তির, এখানে সংগঠনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’