জাহাঙ্গীরনগরের শহীদ মিনারের প্রতিটি ইট যেন প্রেমিক-প্রেমিকার নামফলক
মানুষ স্বভাবতই নিজেকে ভালোবাসে। হৃদয়বৃত্তির ব্যাপারকে কেন্দ্র করে একটি ভুবনে মূলত ভালোবাসা দুটি পর্যায়ে বিভক্ত: একটি হলো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম, অন্যটি হলো সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম।
আজকাল আমাদের চারিদিকে সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির গভীর প্রেমের প্রকাশ দৃশ্যমান হয় অনেককিছুতেই। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেরও এমনিই বেশ কয়েকটি স্থির চিত্র উঠে এসেছে ডেইলি ক্যাম্পাসের ক্যামেরায়।
জাহাঙ্গীরনগরের এই শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত। লাল ইটের তৈরি দেশের সর্বোচ্চ এই মিনারটি দেখতে ও ঘুরতে আসেন বহু দর্শনার্থী।
তবে মিনারের গাঁথুনিতে থাকা প্রায় প্রতিটি ইটে বিভিন্ন বিচিত্রময়ী নামের লেখশিল্প দেখতে পাওয়া গিয়েছে। এতে করে শহীদ মিনারের সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যেতে বসেছে। যুগলদের নিয়মিত আড্ডায় সবসময় সরগরম থাকে শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ, সেখানে সময় কাটাতে আসা যুগলরা নিজেদের তুলি বা কালির আঁচড়ে স্মৃতি করে রাখতে লিখে যান নিজেদের নামস্মৃতি। বেশিরভাগই লেখা রয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকার নামের বাহার।
সরেজমিন গিয়ে দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রায় প্রতিটি ইট যেন একেকটি প্রেমিক প্রেমিকার নামফলক। কেউ হাসিঠাট্টার ছলে লিখেছেন বিভিন্ন নাম। সেখানে ঘুরতে আসা কেউ কেউ বন্ধুদের নাম লিখছেন সারিবদ্ধভাবে। আবার কালির আঁচড়ের নামগুলি কেউ উচ্ছ্বাস এবং হাস্যোজ্জল মনে পড়ছেন।
ইটের গাঁথুনিতে লেখা রয়েছে— আই লাভ ইউ সামিয়া খান নিসাত, শান্ত প্লাস ত্রিশা, অনিক লাভ রিয়া। কেউ কেউ আবার ঘুরতে এসে নিজের নাম লিখে গিয়েছে। অনেকে আবার নিজের নাম বিভাগ ও ব্যাচ লিখেছেন। বান্ধবীরা একে অপরে কেঁউকেঁউ তাদের নাম লিখে রেখেছেন। নামলেখা দেখে মনে হয়েছে অধিকাংশ লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীর।
শুধু তাই নয় অনেকে নিজেদের প্রেমিক বা প্রেমিকা রূপে স্থায়ী করার প্রয়াসে ছোট স্টিল ও কাঠের বোর্ডে নাম লিখে লাগিয়ে দিয়েছেন পেরেকের আস্তর। এমনি একটা ছোট বোর্ডে লেখা আছে তালহা প্লাস মারজিয়া। আরেকটি বোর্ডে লেখা আছে সালমা জিও ৫২ ও জেরিন জি ৫২।
আরও পড়ুন: পেছাল জাবির প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরুর তারিখ
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ লোকমান গালিব বলেন, শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার্থে যেমন জুতা পায়ে মূল বেদিতে ওঠা উচিত না, ঠিক তেমনই অন্য সব সাধারণ জায়গার মত এর দেয়ালে হাসি ঠাট্টার হোক বা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক কিংবা প্রেমের নিদর্শন, কোনো লেখাই লেখা উচিত না। নয়তো দেখা যায় শহীদ মিনারে এসে দর্শনার্থীরা এটা তৈরির উদ্দেশ্য বা ব্যতিক্রমী আকৃতির কারণ খোঁজার চেয়ে ‘অমুক প্লাস তমুক’ লেখা পড়ে হাসিঠাট্টা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আনিকা আঞ্জুম মুনা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, বর্তমান জেনারেশনে যারা আছে, তাদের কাছে শহীদ মিনারের অতীত ইতিহাস বা আমরা যে রক্তের বিনিময়ে এটা পেয়েছি, এর অনুভূতি বা মূল্যবোধটাই নাই। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পর্যায়ে যারা আছেন তাদেরও অপারগতা আছে। কারণ আমরা তাদের শহীদ মিনারের মহত্ত্ব বোঝাতে সক্ষম হইনি।
শিক্ষার্থী আনিকা আরো জানিয়েছেন, ‘বই থেকে প্রায় প্রতিটি ক্লাসে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ে আসতেছি কিন্তু সেগুলো অনুভূতিতে আসছে না। কারণ ইতিহাসকে ব্যবহার করে আমরা মানুষের মাঝে বিভাজন তৈরি করেছি। এছাড়াও ভাষা শহীদদের প্রতি যে সম্মান এটা সবার নিজ থেকে আসা উচিত। যারা আবেগে শহিদ মিনারের মতো জায়গায় প্রেমিক প্রেমিকার নাম লিখছে এগুলো ঠিক না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টাও নিশ্চিত করা উচিত।’
আরও পড়ুন: অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন জাবির সেই শ্যুটার শামীম
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’