শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পরোনি কেন- শিক্ষকের অস্বস্তিকর বক্তব্যে-আচরণে অসহায় ছাত্রীরা
”তুমি শাড়ি পরতে পারো? শাড়ির সাথে ব্লাউজ ম্যাচিং করে পরোনি কেনো? কুচি দিয়ে শাড়ি পরতে কত সময় লাগে? তোমার মিষ্টি হাসি আমার ভালো লাগে, আমায় ভালোবাসো?”
উপরের মেসেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া এক শিক্ষকের বক্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয়টির মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভাগের নারী শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। এ বিভাগের সাতজন শিক্ষার্থী অনলাইনে ও সরাসরি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে এ অভিযোগ জানিয়েছেন।
হেনস্তার শিকার ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ক্লাসের অপেক্ষাকৃত সুন্দরী মেয়েদের লক্ষ্য করে গভীর রাতে ভিডিও কল করতে বাধ্য করতেন। এছাড়াও ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দেখানোর নাম করে হাত ধরার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে জয় বাংলা স্লোগান দিতেও বাধ্য করেছেন।
২০০৬ সালে অভিযুক্ত শিক্ষক ড. আবুল কালাম আজাদকে নারী ঘটিত বিষয়ে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে যোগদান করেন।
শিক্ষার্থীরা আরো অভিযোগ করেছেন, ক্লাসে পর্দা করা নারী শিক্ষার্থীদের মাস্ক বা নিকাব খুলে চেহারা দেখাতে বাধ্য করা, ক্লাসে সুন্দরী নারী শিক্ষার্থীদের সামনের সারিতে বসিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানো। ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলাকালীন ওয়াশরুমে যেতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ করেছেন তারা।
আরও পড়ুন: স্লিভলেস ব্লাউজে ফটোশ্যুট, ঢাবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে কলেজছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ
মার্কেটিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে অভিযুক্ত শিক্ষক ড. আবুল কালাম আজাদকে নারী ঘটিত বিষয়ে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী সমর্থিত নীল দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে মেয়েদের টেবিলের উপর বসে গল্প করতেন ড. আবুল কালাম আজাদকে। তিনি প্রায়ই হুমকির সুরে বলতেন, "আমি মার্কস কমিয়ে দিবো, কেউ ৫০ দিলে আমি ৩০ দিব, তখন মার্কস এমনিতেই কমে যাবে"।
বিভাগের আরেক নারী শিক্ষার্থী বলেন, একাউন্টিং কোর্সে প্রেজেন্টেশন চলছিল। একজন প্রেজেন্টশন দিচ্ছে। আমি পেছনে ছিলাম। ওনি সামনে ডেকে নিয়ে এসে আমাকে বললেন কোন চ্যাপ্টারের প্রেজেন্টশন দেবে। এগুলো জিজ্ঞেস করতে করতে বলেন ‘আমাকে ভালোবাসো’? এ সময় আমি বিব্রতকর অবস্থায় পরে যাই।
এ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথম বর্ষে থাকতে তিনি শুধু আমাকে মাস্ক খুলতে বলতেন। তবে তাকে আমি তেমন সুযোগ দিতাম না। তিনি শুধু আমাকে নয় ক্লাসের আরো মেয়েদের শুধু মাস্ক খুলতে বলতেন। চেহারা দেখতে চাইতেন এবং ওনার চাহনিও খুব অস্বাভাবিক ছিল।
এ শিক্ষার্থী আরো বলেন, তিনি আমাকে একদিন হোয়াটসঅ্যাপে তার ফেসবুক আইডির লিংক মেসেজ দিয়ে বলেন তাকে যাতে আমি রিকোয়েস্ট পাঠাই। আমার নম্বরটি উনি একদিন ক্লাসে খুব কৌশল করে নিয়েছিলেন। তবে আমি তাকে রিকোয়েস্ট পাঠাই নি। তাকে বরাবরের মতই ইগনোর করার চেষ্টা করছিলাম।
ক্লাসে পর্দা করা নারী শিক্ষার্থীদের মাস্ক বা নিকাব খুলে চেহারা দেখাতে বাধ্য করা, ক্লাসে সুন্দরী নারী শিক্ষার্থীদের সামনের সারিতে বসিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানো। ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলাকালীন ওয়াশরুমে যেতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ করেছেন তারা।
তিনি একদিন আমাকে ক্লাসে সামনে ডেকে বললেন, "তোমার আচরণ এমন কেন? তোমার ফ্যামিলি কি খুব কনজারভেটিভ নাকি? মেসেজের কোনো উত্তর দাও না। এরকম অ্যাক্টিভিটি কোনো স্টুডেন্টের হতে পারে না তার টিচারের সাথে। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি আমাকে ইগনোর করো।"
এ নারী শিক্ষার্থী আরো বলেন, একদিন ক্লাসে প্রেজেন্টেশনের সময় আমি প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলাম এবং শুরুতেই আমার একটি ছবি প্রথম স্লাইডে ছিল ইন্ট্রোর (ভূমিকা) পার্ট হিসেবে। ১-২ সেকেন্ডের মত ছবিটি ছিল। তারপর অন্য স্লাইডে যাওয়ার পরপরই তিনি বলেন, "দেখি ছবিটা আবার। কী সুন্দর!“
আরও পড়ুন: ভাসমানদের ভয় তাড়া করছে ঢাবি ছাত্রীদের
মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আজাদ স্যারকে শুরু থেকেই দেখেছি একজন কুচরিত্রের মানুষ হিসেবে। ওনি প্রেজেন্টেশনের সময়ে মেয়েদের থেকে শাড়ি কীভাবে পরে তার বর্ণনা শুনতে চাইতেন। এছাড়া ক্লাসে সে মেয়েদের দাড় করিয়ে মাস্ক খোলাতেন আর মুখ দেখতেন অস্বস্তিকরভাবে। সে প্রতিদিনই এই কাজ করত।
‘আজাদ স্যারের বিরুদ্ধে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব মেয়েদের অনেক অভিযোগ আছে। তিনি খুব বাজে নজরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রেজেন্টেশনের সময় সবাই মোটামুটি ভালো পোশাক পরে আসে। বিশেষ করে মেয়েরা শাড়ি পরে। তিনি শাড়ি পরা মেয়েদের দিকে খুবই বাজেভাবে তাকান।’
এ শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমার কিছু সহপাঠী বিরক্ত হয়ে তার মাস্ক খোলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও করেছে। তার দৃষ্টিভঙ্গি সবই ছিল খারাপ। ছেলেদের সে সবসময় অপমানের উপর রাখত। আমি চাইনা আমার কোনো জুনিয়র বোন এমন পশুরূপি কারও দ্বারা লাঞ্ছিত হোক।
বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে থাকা মাস্টার্স পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আজাদ স্যারের বিরুদ্ধে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব মেয়েদের অনেক অভিযোগ আছে। তিনি খুব বাজে নজরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রেজেন্টেশনের সময় সবাই মোটামুটি ভালো পোশাক পরে আসে। বিশেষ করে মেয়েরা শাড়ি পরে। তিনি শাড়ি পরা মেয়েদের দিকে খুবই বাজে ভাবে তাকান।
এ শিক্ষার্থী আরো বলেন, প্রেজেন্টেশনের দিন আমি শাড়ি পড়েছিলাম আমাকেও খুব বাজেভাবে হয়রানি করেছেন। শাড়ি কে পরিয়ে দিয়েছে এসব জিজ্ঞেস করেছেন। যারাই শাড়ি পরে তাদের এটা জিজ্ঞেস করত। পর্দা-করা এক মুসলিম মেয়েকে মাস্ক খুলতে বাধ্য করেছেন।
চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রেজেন্টেশনের সময় তিনি আমাকে বলেন, শাড়ির সাথে ব্লাউজ ম্যাচিং করে পরোনি কেনো? আচ্ছা কুচি দিয়ে শাড়ি পরতে কত সময় লাগে? একথা গুলো বলতে আমার এখন জিদ উঠছে। উনার নামে কেউ কিছু বলতে পারতোনা। কোর্সে ফেইল করিয়ে দেওয়ার এবং ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিতো।
এ প্রসঙ্গে জানতে অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। এসএমএসের উত্তর দেননি। ভাগে সশরীরে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও শিক্ষকের বাসায় যোগাযোগ করতে গেলে সেখানেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এবিএম শহীদুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার বিভাগের শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তা অ্যাকাডেমিক কমিটিতে উত্থাপন করতে পারবো। তখন আলোচনা ও সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে যাওয়া হবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে। আমাদের দায়িত্ব হলো বিভাগের সকল শিক্ষককে নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো।
আরও পড়ুন: ঢাবি অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে আরেক ছাত্রীর অভিযোগ দায়ের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে স্মারকলিপি জমা দিলে আমরা চেয়ারম্যানকে অবগত করব সমাধান করার জন্য। চেয়ারম্যান বিষয়টি সমাধান করতে না পারলে ডিন মহোদয়কে আমরা জানাবো। এছাড়া আমরা একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করব যেখানে থাকবেন আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং প্রক্টরিয়াল টিমের একজন সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি বা অভিযোগ জমা দিলে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবো। এরপর বিচার বিবেচনা করে বিষয়টি যদি গুরুতর মনে হয়, তাহলে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।