বটতলায় কোরআন তেলাওয়াত করায় ভিসি বাংলোর ইমামতি চলে যায় জাওয়াদের
চলতি বছরের ১০ মার্চ পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় কোরআন তেলাওয়াতের আসর। আরবি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত এই আসরে কোরআন তেলাওয়াত করেন বিভাগটির ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল জাওয়াদ।
তবে এর খেসারত হিসেবে জাওয়াদকে পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা; হারাতে হয় তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের বাংলোতে তারাবির নামাজের ইমামতি। শুধু ভিসি বাংলোর ইমামতি নয়, পরবর্তীতে রাজধানীর পুরান ঢাকার অন্য আরেকটি মাদ্রাসা মসজিদে তারাবির ইমামতির সুযোগ পেলেও জীবনের হুমকির মুখে সেটাও হারাতে হয় জাওয়াদকে।
‘পুলিশকে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতা ঢাবির ভিসি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল অবশেষে পদত্যাগ করলেন! উনার সাথে আমার হৃদয় বিদারক নির্মম কিছু স্মৃতি আছে, লিখবো নাকি?’—জাওয়াদের ফেসবুক স্ট্যাটাস
ছাত্রলীগের রোষানল থেকে বাঁচতে এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্য সেন হল ছেড়ে মেসে চলে যান জাওয়াদ। ক্লাস-পরীক্ষার বাইরে ক্যাম্পাসে আসতে পারতেন না তিনি। শিবির ট্যাগ দেওয়ায় ক্যাম্পাসে আসলেও নিজের পরিচয় লুকাতে মুখে মাস্ক পরে আসতেন তিনি। কষ্টের সেই স্মৃতি তুলে ধরেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে।
আরও পড়ুন: ঢাবিতে কোরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিতে ডিনের চিঠি
জাওয়াদ জানান, আমার একটাই দোষ দেয়া হয়; তা হলো- বটতলায় কোরআন তেলাওয়াত করেছি তাই আমার সাথে জামাত শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘হাফেজদের জন্য রমজান মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি ইন্টারন্যাশনাল হল মসজিদের ইমামের মাধ্যমে ভিসি বাংলোতে তারাবি পড়ানোর সুযোগ পাই। কিন্তু প্রথমদিন তারাবি পড়ানোর পর দ্বিতীয় দিন বিকেলে যখন বটতলায় কোরআন তেলাওয়াত করার ছবি ছড়িয়ে পড়ে; তখন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল স্যার ইন্টারন্যাশনাল হলের মসজিদের ইমামের মাধ্যমে আমাকে তারাবি পড়াতে যেতে নিষেধ করেন।’
ভিসি বাংলোতে মসজিদ না থাকলেও সেখানে কেন ইমামতি— এমন প্রশ্নের জবাবে জাওয়াদ বলেন, ‘মূলত ভিসি স্যার বাংলোর অন্য লোকদের নিয়ে বাংলোতে তারাবি পড়ার উদ্যোগ নেন। তাই আমাকে সেখানে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু কোরআন তেলাওয়াত করার অপরাধে সেখান থেকে আমাকে নিষেধ করা হয়। কিন্তু আমার পরিচিতজনরা যখন এ ঘটনা জানতে পারে; তখন হিফজ ঠিক রাখার চিন্তা করে পুরান ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ছাত্রদের নিয়ে তারাবি পড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়।’
‘হাফেজদের জন্য রমজান মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রথমদিন তারাবি পড়ানোর পর দ্বিতীয় দিন বিকেলে যখন বটতলায় কোরআন তেলাওয়াত করার ছবি ছড়িয়ে পড়ে; তখন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল স্যার ইন্টারন্যাশনাল হলের মসজিদের ইমামের মাধ্যমে আমাকে তারাবি পড়াতে যেতে নিষেধ করেন।’ —আব্দুল্লাহ আল জাওয়াদ
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামালের পদত্যাগের পর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায় জাওয়াদকে। কুরআন তেলাওয়াত অনুষ্ঠান হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সেসময়ে আরবি বিভাগের চেয়ারম্যানকে শোকজ দেয়া ১৯ আগস্ট কলা অনুষদের ডিন থেকে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির। সে বিষয়টি নিয়েও প্রতিক্রিয়া জানান আরবী বিভাগের এই ছাত্র। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় কুরআন তিলাওয়াতের আয়োজন করা শিক্ষার্থীদের পরিচয় জানতে চেয়ে আরবী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল- কলা অনুষদের সদ্য বিদায়ী ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির। আমি সেদিনের অন্যতম তিলাওয়াতকারী হিসেবে আমার পরিচয় দিচ্ছি।’ (ইষৎ সংক্ষিপ্ত পোস্ট)
রমজানের সেই ঘটনাগুলো উল্লেখ করে জাওয়াদ আরও বলেন, ‘কিন্তু কষ্টের কথা হলো, সেখানেও ৭ থেকে ৮ দিন তারাবি পড়ানোর পরে জানতে পারি হলের প্রতিটি রুমে রুমে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে খুঁজছে। তখন আমার বিভাগের চেয়ারম্যান ব্যাচের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভের মাধ্যমে আমাকে তথ্য দেন যে আমি যেন দ্রুত ঢাকা ত্যাগ করি এবং হলে না ফিরি। স্যার নিরাপত্তার জন্যই আমাকে হল ছেড়ে দিতে বলেন। পরে সাথে সাথে আমি গ্রামে চলে যাই।’
আরও পড়ুন: ঢাবিতে কোরআন পাঠ অনুষ্ঠান নিয়ে উপাচার্যকে উকিল নোটিশ
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধার বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিকভাবে আর যেতে পারিনি। সবসময় মুখে মাস্ক পরে যাতায়াত করতে হতো। এমনকি ক্লাস পরীক্ষা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চলাচল করতে পারিনি।’ ‘কিন্তু হলে আমি কোন রুমে থাকতাম সেটা মাকসুদ কামাল স্যার ছাড়া আর কেউ জানত না। কারণ স্যার সূর্য সেন হলে প্রভোস্ট ছিলেন। পাশাপাশি প্রথমদিন তারাবি পড়াতে যাওয়ার পর আমার পরিচয় জানেন। কোন হলে কত নাম্বার রুমে থাকি এসব জানতে চাইলে আমি সব বলি। আমার ধারণা স্যারই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে তথ্য দেন।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, এ ঘটনায় গত ১৩ মার্চ পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বটতলায় কোরআন তেলাওয়াত বিষয়ক অনুষ্ঠান যেসব শিক্ষার্থী আয়োজন করেছে, তাদের কেন শাস্তি প্রদান করা হবে না সে বিষয়ে জবাব চেয়ে আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জুবায়ের মোহাম্মদ এহসানুল হক বরাবর শোকজ লেটার প্রেরণ করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির।