যে প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পক্ষে-বিপক্ষে ছিলেন যারা
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। ১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ গঠন বা বঙ্গভঙ্গ এবং ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল। তখন এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত ছিল।
তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গে কিছু হিন্দু, মুসলমান, পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে অবস্থান নেন। অপর দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা এবং ঢাকার হিন্দু জমিদারদের কেউ কেউ এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কথিত আছে, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন। তবে এ দাবির পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ তেমন নেই।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ওই বছরই ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং 'দ্য অ্যাক্ট অব ইনকরপোরেশন' পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপীয় মডেলে। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারের সন্তানরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও উঁচুতে ধরা হতো। বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় কলেজ ছিলো নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল না।
১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়, যা বঙ্গভঙ্গ নামে প্রচলিত। পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা এ উদ্যোগের একটি অংশ ছিল। মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এমন আশায় উজ্জীবিত ছিলেন। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলে মুসলমানদের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তারা মনে করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়, যা বঙ্গভঙ্গ নামে প্রচলিত। পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা এ উদ্যোগের একটি অংশ ছিল। মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এমন আশায় উজ্জীবিত ছিলেন। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলে মুসলমানদের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তারা মনে করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
লেখক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বইতে লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাঙালি মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা এবং আসাম প্রদেশ গঠনের অনেক আগে থেকেই। ক্ষোভের কারণ শুধু হিন্দু প্রাধান্য নয়, শিক্ষাক্রমে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই বইতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলন রাজনীতিবিদ রাশবিহারী ঘোষও।
আরও পড়ুন : শিক্ষার্থী না হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্বে যারা
ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় ফিরে গেলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। তবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে বিরোধী অবস্থান থেকে সড়ে আসেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তিনি সহযোগিতা করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে চর্চা চলে এখনো। যারা দাবি করেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন তারা স্বপক্ষে দালিলিক কোন তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি। তখনকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং রবীন্দ্রনাথের সেই সময় যাদের সঙ্গে উঠা-বসা ছিল তাদের কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে।
কথা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক কুলদা রায়ের লেখা 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ' নামক প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান, পূর্ববঙ্গের কিছু মুসলমান ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। তারঁ মতে, পশ্চিমবঙ্গের ওই মুসলমানরা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। পূর্ব বাংলার ওই মুসলমানরা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানরা যখন মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পাড় হতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় হলে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা খুব কম থাকবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারের পক্ষে ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
আরও পড়ুন : ঢাবিতে গণত্রাণের মোট হিসাব প্রকাশ, সংগ্রহ ৭ কোটি ৭৮ লাখ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে চর্চা চলে এখনো। যারা দাবি করেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন তারা স্বপক্ষে দালিলিক কোন তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি। তখনকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং রবীন্দ্রনাথের সেই সময় যাদের সঙ্গে উঠা-বসা ছিল তাদের কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বই এ লিখেছেন, শ্রেণিস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন, তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বই এ লিখেছেন, শ্রেণিস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন, তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ।
আরও পড়ুন : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে শিক্ষক-সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানি
আবার যারা রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেননি বলেছেন তাঁরা এর স্বপক্ষে বেশ কিছু ঘটনা এবং এবং দিন তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন, কেউ কেউ কোনো প্রমাণ উপস্থিত না করেই লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। ও রকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল তা অসম্ভব। কারণ সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ সিটি অব প্যারিস জাহাজযোগে রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার কথা ছিল। তার সফরসঙ্গী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্র জাহাজে উঠে পড়েছিলেন, কবির মালপত্রও তাতে তোলা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আকস্মিকভাবে ওইদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে মাদ্রাজ থেকে তাঁর মালপত্র ফিরিয়ে আনা হয়। কলকাতায় কয়েক দিন বিশ্রাম করে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন।
তবে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতেই ওই বৈঠকগুলো করেছেন বলে কোন তথ্য প্রমাণ নেই।
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। এ কে ফজলুল হকের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।