প্রশাসনিক শূন্যতায় চবি ক্যাম্পাস, নতুন উপাচার্য নিয়ে যা ভাবছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভেঙে পড়েছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কার্যত অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। উপাচার্য থেকে শুরু করে উপ-উপাচার্যসহ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার।
গত ১১ই আগস্ট পদত্যাগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য ও দুই উপ-উপাচার্য। তবে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। এতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন কিভাবে হবে, কারা থাকবেন তা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য কেমন হওয়া উচিৎ এ বিষয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ. জি. এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, অবশ্যই মেধা, যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া উচিৎ। একজন শিক্ষকের একাডেমিক দক্ষতার পাশাপাশি প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে সংস্কারের বিষয়ে সেটাকে যারা নৈতিকভাবে গ্রহণ করতে পারবেন তাদেরই এ জায়গায় আসা উচিৎ বলে মনে করছি। আমার মনে হয় শিক্ষার্থীরাও এটাই চায়। ছাত্র আন্দোলনে যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কাউকেই ছাত্ররা মেনে নিবে না। সুতরাং আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নৈতিকভাবে সমর্থন করেছিলেন তাদের সুযোগ পাওয়া উচিৎ।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কেমন উপাচার্য চান জানতে চাইলে চবির সমন্বয়ক আব্দুল আওয়াল আলাওল বলেন, আমরা চাই যিনি আমাদের উপাচার্য হবেন তিনি যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হন অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তাঁর চিন্তা, কাজ, দক্ষতার জায়গাটা ব্যবহার করবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যেন কোনো দলীয়করণের মধ্যে না যায়। তাঁরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থী হিসেবে ট্রিট করবে, কে কোন দলের বা কোন মতের সেটার প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করবেন। তারা নিজেরা যেন কোনো দলভুক্ত না হয়। প্রশাসনই বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে কিন্তু কোনো দলের এজেন্ডা হয়ে কাজ করবে না।
উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতি মূলত দুটি। প্রথমটি ৭৩ এর অধ্যাদেশ, আর দ্বিতীয়টি আচার্য কর্তৃক সরাসরি প্রজ্ঞাপন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুজন উপাচার্য সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮৫ সালে উপাচার্য হন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। এরই মধ্যে ৩৬ বছর পার হলেও সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত উপাচার্য পায়নি আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এ উচ্চশিক্ষলয়।
৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হলে একটা শক্ত ভিত্তি থাকে। এতে আত্মমর্যাদা জন্মায়। আর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারও অনুকম্পায় উপাচার্য নিয়োগ হলে তা সঙ্গত কারণেই থাকে না। গত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামীলীগ সরকারও দ্বিতীয় পথটাই বেশি পছন্দ করেছেন। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হলে দলের লাভ হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭৩ এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ সম্ভব কি-না জানতে চাইলে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী বলেন, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। এখনো সিনেট কার্যকর আছে তবে সিনেট যে সময়ে বা যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আবার সিনেটে যে ছাত্র প্রতিনিধি (চাকসু) থাকার বিষয়টি সেটা এখন নাই। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় তো আর ফাঁকা পড়ে থাকবে না কাউকে না কাউকে তো নিয়োগ দিবেই সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় ধাপটি অনুসরণ করে আচার্য ভিসি নিয়োগ দিবেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের ফসল হিসেবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন একাডেমিক্যালি ও নৈতিকভাবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য জ্ঞান ও গবেষণা নির্ভর শিক্ষককে ভিসি হিসেবে দেখতে চাই, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন। যিনি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করবেন- যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং সম্মানজনক জায়গায় যায়, এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ক্যাম্পাসকে সকলপ্রকার বৈষম্যমুক্ত (শাটল ট্রেন পরিবহন, হলে সিট্ বন্টন, খাওয়ার মান) পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একইসাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার শিক্ষাবান্ধব সুসম্পর্ক সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবেন। অর্থাৎ যার কর্মতৎপরতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল বার্তা তথা সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ক্যাম্পাসে ক্লাস, পরীক্ষাসহ সকল সেবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য ছাত্র সংসদসহ সকল সংসদ/সিনেটের ইত্যাদির আশু নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ম দূর করতে হবে।
লোক প্রশাসন বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, আমাদের প্রত্যাশা হলো একাডেমিকভাবে যোগ্য এবং প্রশাসনিকভাবে দক্ষ একজন সৎ ব্যক্তি এই স্থানে আসুক যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা হবে। তিনি এমনভাবে সবাইকে নিয়ে ন্যায়নীতির ভিত্তিতে কাজ করবেন। ছাত্র সংসদ কার্যকর হলেই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব কার্যকর হবে বলে মনে করি। আমি মনে করি সামনে এমন উপাচার্য আসবেন যিনি শিক্ষার্থীবান্ধব হবেন যিনি দল মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন।