০১ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪৪

পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে, যোগ দিচ্ছেন শিক্ষকরাও 

একজন শিক্ষার্থীকে আটক করতে চাইলে তাকে বাচাঁনোর চেষ্টা করছেন ঢাবি শিক্ষক  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দিচ্ছেন শিক্ষকরাও।  ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে গতকাল বুধবার রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ধস্তাধস্তি হয়েছে। অনেক এলাকায় কর্মসূচি পালনে বাধা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আহত হয়েছেন শিক্ষকরাও।  

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও আইনজীবীরা। কোনো কোনো স্থানে লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। সব মিলিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন অন্তত ৯০ জন। ভাঙচুর করা হয়েছে একাধিক যানবাহনও।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের মুক্তি, শিক্ষার্থী হত্যা, গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তিসহ ৯ দফা দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের। গত মঙ্গলবার রাতে টেলিগ্রাম অ্যাপে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি।

ঘোষণায় বলা হয়, দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে এ কর্মসূচি পালন করা হবে। শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবীসহ সব নাগরিককে কর্মসূচিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার অনুরোধ জানানো হয়।

এদিকে আজ বৃহস্পতিবার নতুন কর্মসূচি ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল বুধবার আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, এ কর্মসূচি অনুযায়ী আজ শিক্ষার্থী নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতের স্মৃতিচারণ করা হবে। শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীরা স্মৃতিচারণ করবেন। শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে চিত্রাংকন, গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন, ডিজিটাল পোর্ট্রেট প্রভৃতি তৈরি করা হবে। 


মার্চ ফর জাস্টিসে’ পুলিশের বাধা

কার্জন হলের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট মোড়ের দিকে এগোতে চাইলে তাদের শিশু একাডেমির সামনে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। একটু পরে বুয়েটের মেইন গেট থেকে শিক্ষার্থীর একটি দল মিছিল নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরে সেখানে বক্তব্য দেন সাদা দলের শিক্ষকরা। কর্মসূচিতে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুস সালাম, অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান, কোষাধ্যক্ষ আবুল কালাম সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১টার দিকে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি কলেজের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী কর্মসূচিতে যোগ দিতে হাইকোর্ট মোড়ের দিকে আসার সময় এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটক করতে গেলে সেখানে ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নুসরাত জাহান চৌধুরী ও প্রভাষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া বাধা দেন।

সেখানে রমনা জোনের এসি মোহাম্মদ ইমরুল পুলিশের নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ইমরুল ওই ছাত্রকে আটক করার চেষ্টার করলে শেহরীন আমিন বাধা দেন। এ বিষয়ে শেহরীন আমিন বলেন, ‘বোরহানুদ্দীন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি ও আমার সহকর্মী নুসরাত জাহান গিয়ে বাধা দিই। পুলিশকে বললাম, তার অপরাধ কী? পুলিশ বলল, তাকে চেক করব। তখন আমি পুলিশকে বলি, চেক করার থাকলে এখানে করেন। আমাদের ব্যাগ, ফোন চেক করেন। পুলিশ তখন বারবার বলছিল, আমি কিন্তু বল প্রয়োগ করব। এর পর পুলিশ ধস্তাধস্তি করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি ওই শিক্ষার্থীর হাত শক্ত করে ধরে রাখছিলাম। তখন এক পুলিশ আমার হাত ধরে ধাক্কা দেয়।’

এরপর অধ্যাপক নুসরাত জাহান বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে আমরা পারিনি। আমরা যখন তাদের পাশে দাঁড়াতে পারব না, ১২০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নেওয়ার নৈতিক অধিকার আমার থাকবে না।’

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। প্যারিস রোডে ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল আলিমের সভাপতিত্বে এ কর্মসূচিতে বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ৬০ শিক্ষক অংশ নেন। অন্যদিকে প্যারিস রোডে শিক্ষার্থী দুর্ভোগসহ অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহতের ঘটনার সুষ্ঠু বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ। এ সময় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন। এতে চার শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। এদিকে রাতে চার শিক্ষার্থীসহ ১২ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষকরা ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ’ ও ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের’ ব্যানারে শহীদ মিনারে আলাদা মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার দাবি করেন।

পুলিশি বাধা ও তল্লাশির মুখে কর্মসূচি পালন করতে পারেননি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় ইবিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কুষ্টিয়া কালেক্টরেট চত্বর ও আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে পারেননি। এ সময় ১৪ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ১১ জন ইবি শিক্ষার্থী। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা অংশ নেন। মিছিল শেষে সমাবেশে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এত নির্মমতা, হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন-নিপীড়নের পরও সরকার দায় স্বীকার করেনি। আন্দোলন এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-জনতার হয়ে গেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার করুন।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা। এতে বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ৬০ শিক্ষক অংশ নেন। মূল ফটকের সামনে সংহতি সমাবেশে অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা কি স্মাগলার? তারা কি খুনি? তারা শুধু নিজেদের অধিকার চেয়েছে। আমরা ছাত্রদের পাশে রয়েছি।’