১৫ জুলাই ২০২৪, ১১:৪২

যে স্লোগানে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করলেন শিক্ষার্থীরা

কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস  © সংগৃহীত

মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস। ঢাকায় ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসিতে জড়ো হন হাজারো শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবিবার রাত ১০টার পর প্রথমে বিভিন্ন হলের ভেতরে জড়ো হয়ে স্লোগান আর বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা। পরে রাত ১১টার পর থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। মিছিল আর স্লোগানে স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করেন তারা।

বিক্ষোভ মিছিলের পুরো সময়জুড়ে শিক্ষার্থীদের মুখে বিভিন্ন স্লোগান শোনা গেছে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধিদের তথ্যমতে উল্লেখ্য স্লোগানগুলো ছিল- ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; কোটা না মেধা, মেধা-মেধা’; ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার! রাজাকার!’; ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’; 'স্বৈরাচার, স্বৈরাচার', ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার! রাজাকার!, কে বলেছে কে বলেছে, সরকার! সরকার!’| 

মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত এ বিক্ষোভ মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সবগুলো ক্যাম্পাসে একই ধরনের কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সবগুলো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মুখে প্রায় অভিন্ন স্লোগানে শোনা গেছে পুরো সময়জুড়ে।

অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতো মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে এগারোটার পরে মাদার বখস হলের দিক থেকে মিছিল শুরু হয়। পরে রাত বারোটার দিকে মিছিলটি প্যারিস রোডে এসে পৌঁছায়। সেখানে অবস্থান তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন

এসময় রাবি শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। এসময় শিক্ষার্থীদের মুখে ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার! রাজাকার!’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, সরকার! সরকার!’ স্লোগান শোনা গেছে।

এর আগে, রবিবার (১৪ জুলাই) বিকালে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সম্প্রতি চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে প্রসঙ্গেক্রমে কোটা সংস্কার আন্দোলনও উঠে আসে। 

এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না?’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের ‘অবমাননা করা হয়েছে’ দাবি করে মধ্যরাতে তারা রাজপথে নেমে আসেন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রধানমন্ত্রী ‘রাজাকারের নাতি-পুতি বলেছেন’—এই কথাটি সঠিক নয়। তিনি বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের জন্য কোটা থাকবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিদের জন্য থাকবে? এটা তো যৌক্তিক প্রশ্ন।

নেক্সাস টেলিভিশনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিষয়ক সম্পাদক আমিন আল রাশেদ ফেসবুকে লিখেছেন, আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর এই কথাকে টুইস্ট করে কিংবা অর্ধেক না বুঝেই পাল্টা হিসেবে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’—এই বলে নাকি স্লোগান দেয়া হয়েছে। এটাও অর্ধ সত্য। খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্রকৃত অর্থে স্লোগানটা ছিল এরকম: ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে সরকার সরকার।

তিনি বলেন, যদি স্লোগানটা এরকম হয়েও থাকে—তারপরও ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’—এই স্লোগান দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি এই আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা যা কিছুই বলুন না কেন—নিজেকে ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা ধৃষ্টতা। এটা দেশকে অবমাননা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান।

অবশ্য পরে ‘রাজাকার’ স্লোগানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেছেন, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা যে স্লোগানটি দিয়েছে সেটি ছিল ‘তুমি নই আমি নই, রাজাকার! রাজাকার!’। অর্থাৎ আমি কিংবা তুমি কেউই রাজাকার নই।

আসিফ বলেন, সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন, সরকারের দায়িত্বশীল এমপি-মন্ত্রীরা এটাকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থীরা কখনো নিজেকে রাজাকার হিসেবে সাব্যস্ত করেননি। শিক্ষার্থীরা বারবার বলেছেন, আমরা রাজাকার নই।

তবে আসিফের এমন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন মুহাম্মদ শাহজাহান হোসেন নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী। তিনি রাজাকারের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানটিও শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দিয়েছেন। তবে এটার উদ্দেশ্য বুঝতে হবে। শিক্ষার্থীরা কোন সেন্সে স্লোগানটি দিয়েছেন, সেটা সরকারপক্ষ এবং তাদের ছাত্রসংগঠন বুঝেও না বোঝার ভান করছে। শাহজাহান বলেন, ‘স্লোগানটি ছিল স্রেফ একটি প্রতিবাদের ধরন বা প্যারোডি।’

এদিকে, মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর পেয়ে মধুর ক্যান্টিন, শাহবাগ এবং নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অবস্থান নিতে শুরু করে। এসময় বিভিন্ন জনের হাতে লাঠি-সোঁটাও দেখা গেছে। পরে রাত ১টার দিকে কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে গেলে বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয় ছাত্রলীগ।

এসময় তারা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে এসে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এসময় তারা- ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘আছিস যত রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।

সংগঠনটির বিক্ষোভ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন, সোমবার থেকে দেশের রাজপথে আর কোনও রাজাকার থাকবে না। প্রত্যেক জেলা, মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা, দেশে যারা নৈরাজ্য তৈরি করতে চায়, যারা লাখো শহীদের রক্ত নিয়ে তামাশা করবে, রাজপথেই এর ফয়সালা হবে।