শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষার কী হবে?
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় রয়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাদের দাবি, নতুন এই স্কিম শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে আনা হয়েছে। গত দু’মাস ধরে বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনের পরও এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে তারা শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি।
এ অবস্থায় আগামী সপ্তাহ থেকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করবেন শিক্ষকরা। এসময় পরীক্ষা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে বলে জানা গেছে। এরপর দাবি আদায় না হলে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে আগামী ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করা হবে বলে জানা গেছে।
এ অবস্থায় আসন্ন জুলাই মাসের শুরু থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে অচল অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে দেশের অর্ধশতাধিক উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠান। গ্রীষ্মকালীন ও ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে গেলেও ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়া নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। অবার অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটে ফিরতে পারে বলে মনে করছেন।
জানা যায়, গত বছরের আগস্টে চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশনে নতুন প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ মার্চ এ নিয়ে দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনে প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। পরে ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন এ স্কিমের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। এরপর তিন দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
তাদের তিনটি দাবি হলো, গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা প্রত্যয় স্কিমের পেনশনবিষয়ক বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। এ তিনটি দাবির কোনোটি সরকার থেকে এখন পর্যন্ত মানা হয়নি। তাই শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আন্দোলন চলমান রেখেছে।
তিন দাবিতে বিবৃতি দেওয়া, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়া এবং অবস্থান কর্মসূচির মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। দু’পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে অচল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
শিক্ষকদের দাবি, প্রস্তাবিত প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়ন হলে বর্তমান শিক্ষার্থী যাঁরা আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসতে আগ্রহী, তাঁরাই এর ভুক্তভোগী হবেন। চলমান আন্দোলন আগামী দিনের তরুণ সমাজের স্বার্থরক্ষা তথা উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে।
গত ৪ জুন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকা অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালিত হয়। এদিন দুপুরে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা ভবনে ফেডারেশনের নেতারা ২৪ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন।
ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন শিক্ষকরা। এছাড়া ৩০ জুন শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন। তবে, পরীক্ষা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে। দাবি আদায় না হলে আগামী ১ জুলাই থেকে দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।
এদিকে, আগামী পহেলা জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া সেমিস্টার পদ্ধতি যাদের চালু রয়েছে তাদেরও নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে। শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের চতুর্থ বর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী শেখ সাদী সাইমন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অ্যাকাডেমিক বছর গণনা করা হয়। নতুন সেমিস্টার,নতুন ইয়ারে পদার্পণের মুহূর্তে ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত হওয়াটা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। এরমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন, কুরবানির এক বিশাল বন্ধ শেষ হতে চলেছে। ঈদের বন্ধের পর টিকিট পাওয়াটা আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকটা দুষ্কর হয়ে উঠে। আমরা পুরোনো স্টুডেন্টদের জন্য ক্লাস হবে কিনা এর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যেমন খুবই কঠিন তেমনি নবীন স্টুডেন্টদের জন্য বিষয়টা খুবই অলক্ষুণে। তাই কর্মবিরতির সময়কাল নিয়ে চিন্তা করাটা খুবই দরকার।
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়লা জুলাই থেকে কোনো একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। গত ৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি।
আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা এবং সরকারের সাথে কোনো ধরনের আলাপ আলোচনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সম্প্রতি অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাদ দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় কিন্তু এ বিষয়ে সরকার আমাদের সাথে এখনও কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা করেনি। আমরা আমাদের পূর্বঘোষিত যে আন্দোলন সেটিতেই বহাল আছি। পহেলা জুলাই সকল প্রকার একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এসময় তিনি বলেন, আমাদের একটি পেনশন স্কিম ছিল। এই স্কিমের আমাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তবুও ধরনের একটি বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পেনশন মানুষকে দেওয়া হয় সুরক্ষার জন্য। সুরক্ষাবলয় দিতে হলে তো পেনশনকে কমানোর পরিবর্তে আরও বৃদ্ধি করা উচিত। কিন্তু সেটা তো করছেই না আমরা সেটা চাচ্ছিও না কিন্তু সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে প্রত্যয় স্কিমে পেনশন তো সীমিত করেছেই সাথে আমাদের অবসরের বয়স যেখানে ৬৫ ছিল সেটাও ৬০ বছর করা হয়েছে। সকল দিক দিয়ে সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং এই আন্দোলন চলমান থাকবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা এখনো আমাদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়নি। আগামী ২২ তারিখে আমাদের শিক্ষকদের মিটিং রয়েছে। সেখানে কর্মসূচি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপের কথা জানানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার থেকে এখনো আমরা কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাইনি। আমরা আশা করি সরকার আমাদের দাবির বিষয়ে বিবেচনা করবে। কর্মসূচি কী চলতে থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলতে থাকবে। ১ জুলাই থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে সর্বাত্মক কর্মসূচি চলবে।