ডেডলাইন পহেলা জুলাই: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুই আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিল ও সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আসন্ন ঈদুল আযহার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দুটি বড় আকারে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এই দুই আন্দোলন নিয়ে সময়ও বেঁধে (আলটিমেটাম) দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্ন হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যেকোনো দাবি-দাওয়া নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে, এতে বাঁধা প্রদানের কিছু নেই। তবে বড় কোনো আন্দোলন হলে তখনই সরকারের সাথে সংশ্লিষ্টদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
আরও পড়ুন: কোটা পদ্ধতি কি আগের মত ফিরবে? মানতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা
জানা গেছে, গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত।
এই রায়ের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশী ও ছাত্র-ছাত্রীরা কয়েকদিন বিক্ষোভ দেখিয়েছে। সর্বশেষ গত ১০ জুন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পহেলা জুলাই ঢাবিতে সর্বাত্মক ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: ১ জুলাই থেকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা
অন্যদিকে, পহেলা জুলাই থেকে পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। এরই অংশ হিসেবে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়লা জুলাই থেকে কোনো একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। গত ৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি।
আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা এবং সরকারের সাথে কোনো ধরণের আলাপ আলোচনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সম্প্রতি অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাদ দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় কিন্তু এ বিষয়ে সরকার আমাদের সাথে এখনও কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা করেনি। আমরা আমাদের পূর্বঘোষিত যে আন্দোলন সেটিতেই বহাল আছি। পহেলা জুলাই সকল প্রকার একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এসময় তিনি বলেন, আমাদের একটি পেনশন স্কিম ছিল। এই স্কিমের আমাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তবুও ধরনের একটি বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পেনশন মানুষকে দেওয়া হয় সুরক্ষার জন্য। সুরক্ষাবলয় দিতে হলে তো পেনশনকে কমানোর পরিবর্তে আরও বৃদ্ধি করা উচিত। কিন্তু সেটা তো করছেই না আমরা সেটা চাচ্ছিও না কিন্তু সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে প্রত্যয় স্কিমে পেনশন তো সীমিত করেছেই সাথে আমাদের অবসরের বয়স যেখানে ৬৫ ছিল সেটাও ৬০ বছর করা হয়েছে। সকল দিক দিয়ে সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং এই আন্দোলন চলমান থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রো-ভিসিদের সাথে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা বা তারা সমর্থন করছেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিসি ও প্রো-ভিসি সম্মতি দিবেন কিনা বা তারা সমর্থন করবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার। তবে ভিসি হওয়ার আগে তিনি একজন শিক্ষক।
“তবুও ভিসি স্যারের কাছে শিক্ষক সমিতির সকল কার্যকরী সদস্যদেরকে নিয়ে আমি আমাদের সকল কথা জানিয়েছি। আমি এ ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়েও সকল তথ্য জানিয়েছি। সুতরাং আমাদের জায়গা থেকে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। তবে এখনও নীতিগত ভাবে কোনো শিক্ষক আমাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেননি।”
তিনি আরও বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোনো নিয়ম কার্যকর করতে হলে যেহেতু সিনেটে পাশ হতে হয় তাই আমি ভিসিকে জানিয়েছি যে এই সার্বজনীন পেনশনের এই প্রস্তাবটি যেন সিনেটে না তোলা হয়। তুললে সেটি পাশ হবে না বলেও জানিয়েছি। তবে অন্য কোনো উপায়ে যদি এটা পাশ করানো হয় তাহলে আমরা শিক্ষক সমিতি সর্বাত্মক আন্দোলন করবো বলে আমি চিঠির শেষ লাইনে উল্লেখ করেছি।
শিক্ষক সমিতি কর্তৃক ঘোষিত একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হলে প্রশাসনের ভূমিকা কী থাকবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশচন্দ্র বাছার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা শিক্ষক সমিতির ব্যাপার। শিক্ষক সমিতির সাথে আমার এখনও বসা হয়নি। তবে ঈদের পরে কেমন আন্দোলন কেমন হবে সেটা না বুঝে কথা বলাটা মুশকিল। আশা করি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকার থেকে আশ্বাস পেলেও ব্যাপারটা একটু সহজ হবে।
তবে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এটি ফেডারেশনের ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না।
২০১৮-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন আবার ফিরছে?
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর কোনো বাধা থাকল না বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী।
এ ঘোষণার দিন থেকেই ওই রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। তারপর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। এদিকে, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় ঈদ হওয়াতে এ উপলক্ষ্যে ছুটিতে রয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাই প্রথম দফার আন্দোলন তীব্র না হলেও ঈদের পরপরই আগামী মাসের শুরুতেই তীব্র আন্দোলন শুরু হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো প্ল্যাটফর্ম করে শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু পরিকল্পনা রয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।
জানতে চাইলে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকারের ইন্দনে সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ছাত্রসমাজ কোনোভাবেই তা বহাল রাখতে দিব না। ঈদের পর যখন ক্যাম্পাস খোলা হবে তখন ঢাবিসহ সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন জোরদার করা হবে। আমাদের দাবি আদায় হওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করবো। ২০১৮ সালের যতটুকু আন্দোলন বেগবান হয়েছিল, এবার তার চেয়ে বেশি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
চলমান এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়ার জন্য এখনও কোনো কমিটি হয়নি। ২০১৮ সালে যারা নেতৃত্বে দিয়েছিলেন এবং বর্তমানে যারা আছে ক্যাম্পাসে রয়েছে (সাধারণ শিক্ষার্থী) সকলকে নিয়ে সমন্বয় করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
এর আগে গত ১০ জুন ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের সমাপনী বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মাহিন সরকার বলেন, ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আমরা সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত আলটিমেটাম দিচ্ছি। ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র বহাল করা না হলে আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনে যাব। প্রয়োজনে আমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেব। তখন সর্বাত্মক ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সদ্য স্নাতক শেষ করা এক শিক্ষার্থী বলেন, আন্দোলন না করে কী করবো? পড়ালেখা শেষ করে চাকরির যতটুকু আশা করেছিলাম সে আশাও তো মাটি হয়ে গেলো। স্বাধীন দেশে এ কেমন বৈষম্যমূলক আচরণ। এই আচরণের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। এসময় তিনি ঈদের পরে এই আন্দোলন ২০১৮ সালের আন্দোলনের মত হতে পারে বলে জানিয়েছেন।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। তখন আমি মাত্র ১ বছর হলো এসেছি ক্যাম্পাসে। তখন কোটা প্রথার বিরুদ্ধে যে ভয়ংকর মনোভাব আমি শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখেছিলাম সেটা এখনও মরে যায়নি। কোটা প্রথাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন চলবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু ভাবছে কিনা বা বড় কোনো আন্দোলন হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা কেমন হবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো বক্তব্য থাকলে তারা সেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করবে। তবে বড় কোনো আন্দোলন হলে তখন সময়ই সব বলে দিবে তখন কী করতে হবে। তবে সরকারের সাথে শিক্ষার্থীদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটি সমাধান হওয়ার বিষয়।