ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে সিগারেটে উড়ছে কোটি টাকা
৩০ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে সিগারেট বিক্রি করছেন জাকির হোসেন (৫০)। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার, আবার কখনো এর বেশিও সিগারেট বিক্রি হয় তার। পাশের আরেক দোকানি মো. সেলিম (৪২)। তিনিও ২৭ বছর ধরে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে সিগারেট বিক্রি করছেন। তারও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়। এছাড়া টিএসটি গোল চত্বরে রয়েছে ৯টি স্থায়ী সিগারেট বিক্রির দোকান। এগুলোতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এভাবে প্রতি মাসে বাধাহীনভাবে সিগারেট বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। মাসে বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার বেশি সিগারেট। ক্যাম্পাসে হরহামেশায় ধূমপান করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীসহ ঘুরতে আসা মানুষের। টিএসসিকে ধূমপানের নিরাপদ জায়গা মনে করেন অনেকে। এ কারণে ঢাবির শিক্ষার্থী নন, এমন অনেক নারীও এ এলাকায় আসেন সিগারেট সেবনের জন্য। অথচ ক্যাম্পাসে ঝুলানো আছে ধূমপানমুক্ত এলাকা ব্যানার।
এমনই একজন রাজধানীর নব কুমার ইনস্টিটিউটের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী এক ছাত্রী। বান্ধবীসহ ধূমপানের জন্য টিএসিতে এসেছিলেন তিনি। নিয়মিত ধূমপান না করলেও প্রায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আসেন টিএসসিতে। এখানে এসে ধূমপান করেন।
বাংলাদেশ ইউনিভাসিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, অন্য কোথাও নারীরা সিগারেট সেবন করলে চোখ বড় বড় করে তাকায় অনেকে। নানান কথা বলে। কিন্তু এখানে সবাই সমান। কেউ কাউকে কিছু বলে না। যার যা ইচ্ছা তাই করে। তাই ধূমপান জন্য নিয়মিত টিএসসি আসেন তিনি। শুধু নারীরা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, এমন বহিরাগত বহু শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী টিএসসি আসেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ধূমপানের জন্য।
“অন্য কোথাও নারীরা সিগারেট সেবন করলে চোখ বড় বড় করে তাকায় অনেকে। নানান কথা বলে। কিন্তু এখানে সবাই সমান। কেউ কাউকে কিছু বলে না। যার যা ইচ্ছা তাই করে। তাই ধূমপান জন্য নিয়মিত টিএসসি আসি-নারী শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভাসিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলেও বিক্রি হয় সিগারেট। এর মধ্যে হাজী মোহাম্মদ মুহসিন হলের তিনটি দোকানে প্রতিদিন প্রায় ১৪ হাজার, কবি জসীমউদ্দিন হলের দু’টি দোকানে ১১ হাজার, সূর্যসেন হলের দু’টি দোকানে ৮ হাজার, শহীদুল্লাহ হলের একটি দোকানে ৭ হাজার ও ফজলুল হক মুসলিম হলের দু’টি দোকানে ৫ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের এক শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণি থেকে সিগারেটে আসক্ত। এখন এর মাত্রা তিনগুণ বেড়েছে। দিনে প্রায় ২০টি সিগারেট লাগে তার, যার দাম ২০০ টাকার বেশি। পুরো অর্থই পরিবার থেকে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এতো ধূমপান করি, এটি বাসার কেউ জানে না। সিগারেটের প্রতি আমার অন্যরকম এক নেশা কাজ করে, যা আমি ছাড়তে পারি না।’
নাম প্রকাশ না শর্তে জিয়া হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সকালে সিগারেট না খেলে টয়লেট হয় না, মন স্থির থাকে না। এমনও হয়েছে যে, পরীক্ষা দেওয়ার সময় ৩ ঘণ্টায় তিনবার বের হয়েছি। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ধূমপান খেয়েছি। এতে মাসে প্রায় ৫ হাজার টাকা লেগে যায়।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থায়ী সিগারেট বিক্রির দোকান রয়েছে ১১টি। এখানকার অন্যতম বিক্রেতা মো. কবির হোসেন (৫০)। ২০০১ সাল থেকে সিগারেট বিক্রি করে আসছেন তিনি। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয় তার। এ উদ্যানের গেটের আরেক পাশে সিগারেট বিক্রি করেন মো. হাসান (৫৮)। তাঁর ভাষ্য, প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয় তার। বাকি দোকানগুলোতেও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিক্রি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভ্রাম্যমাণ হকার বা বিক্রেতা রয়েছেন ৫০ জনের অধিক। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগ হকারই প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করেন। শাকিল (১৮) নামে এক বিক্রেতা রং চায়ের পাশাপাশি প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার বিক্রি করেন। তিনি জানান, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা প্রায় প্রত্যেকে প্রতিদিন একই পরিমাণের সিগারেট বিক্রি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভ্রাম্যমাণ হকার বা বিক্রেতা রয়েছেন ৫০ জনের অধিক। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগ হকারই প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করেন।
সিগারেট ক্ষতিকর এটা জানেন সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক নারী শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি ক্ষতি করে সিগারেট। নারীদের হরমোনাল কিছু বিষয় থাকে। কিন্তু এসব জানলেও ছাড়তে পারেছি না। আজ ছাড়ব কাল ছাড়বো বলে হয়ে ওঠে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সিগারেটের পেছনে ব্যয়কৃত টাকা কোথায় থেকে আসে, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জিয়াউর রহমান হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের সাথে মিশে কৌতুহলে ধূমপান শুরু করি। পরে সিগারেটের প্রতি অন্যরকম নেশা কাজ করে। এখন প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১৫টি সিগারেট লাগে। এর পেছেনে মাসে ৪-৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আমার কোনো আয় নেই। সব খরচ পরিবার বহন করে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূর্যসেন হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হাইস্কুল জীবনে বিড়ি দিয়ে ধূমপান করতাম। কলেজে পদার্পন করে সিগারেট শুরু করেছি। ক্যাম্পাসে আসার পর এর মাত্রা অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন ১৫টি সিগারেট লাগে। মাসে ৪ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রোগামে অংশগ্রহণ করে টাকা উপার্জন করি।সে টাকা দিয়ে সিগারেট খায়।’
“বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের সাথে মিশে কৌতুহলে ধূমপান শুরু করি। পরে সিগারেটের প্রতি অন্যরকম নেশা কাজ করে। এখন প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১৫টি সিগারেট লাগে। এর পেছেনে মাসে ৪-৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আমার কোনো আয় নেই। সব খরচ পরিবার বহন করে- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দশম শ্রেণি থেকে ধূমপান করেন বিজয় একাত্তর হলের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, এখন দিনে ৯-১০টি সিগারেটের প্রয়োজন হয়। মাসে ২-৩ হাজার টাকা লেগে যায়। পরিবার থেকে যে টাকা দেয়, তার থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সিগারেট কেনেন তিনি। কবি জসিমউদদীন হলের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীরও মাসে ৩ হাজার টাকার সিগারেট লাগে। তার পরিবার যে টাকা দেয়, তা দিয়ে ক্যাম্পাসে খাওয়া-দাওয়া ও চলাফেরায় খরচ হয়ে যায়। টিউশনের টাকা দিয়ে সিগারেট কেনেন তিনি।
জানা গেছে, বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক মুক্ত দেশ হিসেবে তৈরির ভিশন নিয়েছে সরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এসব মানার বালাই নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণায় ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ধূমপান যে মাদকের একটি অংশ, এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে আমরা এখনো তুলে ধরতে পারিনি। আর তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে না, ঠিক এমনও নয়।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। এটি বন্ধ করতে চাইলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এটি নিয়ে প্রতিবাদ করে। তারা বলছে- তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ব্যক্তিগত জীবন হস্তক্ষেপ করছে। একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত জীবনে কি করবে, তা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করে দেওয়ার কেউ নয়, এমন প্রতিবাদ করেন শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন: ভুয়া পরিচয়ে ২ বছর চবিতে ক্লাস করেছেন তিনি, ছাত্রলীগের রাজনীতিও করেছেন
ড. তৌহিদুল হকের ভাষ্য, সিগারেট দিয়ে শুরু করলেও অনেকে ধীরে ধীরে মাদকের দিকে ধাবিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ রকম একটি চক্র রয়েছে, যারা সিগারেটের আড়ালে মাদক টিকিয়ে রাখতে কাজ করে। তারা প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ না করলেও সিগারেট বা মাদকে আসক্ত শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সিগারেট বিক্রি করতে না দিলে ভিন্ন রকম পরিবেশ সৃষ্টি হবে, নানা সময় ইঙ্গিত দেয় কিছু মহল। তাই প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও প্রশাসন তার মতো কাজ করতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রের স্বদিচ্ছা- এমন মন্তব্য করে ঢাবির এ শিক্ষক আরও বলেন, জনকল্যাণে রাষ্ট্রের আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও তামাক নিয়ন্ত্রণের আইন যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তাহলেই এটি নিরসন সম্ভব হবে। না হলে খুব একটা আশা দেখছেন না তিনি।
এদিকে আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস। এর এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি , শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তামাকমুক্ত করার দৃশ্যমান তেমন পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের।
সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী নূর নবী বলেন, যারা ধূমপান করে, তাদের উচিত একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ধূমপান করা। কারণ নিকোটিনের ধোয়া অনেকের সহ্য হয় না। আর খুবই জঘন্য লাগে। দেখা গেছে, কোনো এক জাইগায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে একদল এসে সিগারেট খাওয়া শুরু করল। আর সে ধোয়া আমার দিকে মুখ দিয়ে ছেড়ে দিল। এতে নিজেরই অন্য জাইগায় চলে যাওয়া লাগে। অথচ তাদের উচিত ছিল, নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ধূমপান করা।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ধূমপান এবং সিগারেট বিক্রির বিরুদ্ধে কিছু নীতিমালা আরোপ করা, যাতে অন্য শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি না হয়। আমাদেরও সচেতন হওয়া উচিত। আর মুখের সামনে প্রতিবাদ করা দরকার। তাহলে ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা সম্ভব।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা কেউ আইনের বাইরে নয়। আমাদের উচিত আইনকে প্রাধান্য দেওয়া। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা ধুমপানমুক্ত এলাকা, সেহেতু আমাদের উচিত ক্যাম্পাসের সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখা। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। হলের যে দোকানগুলোয় সিগারেট বিক্রি হয়, সেগুলো দেখার দায়িত্ব হল প্রশাসনের।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের ভেতরে যারা সিগারেট বিক্রি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিই আমরা। প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সবসময় এটি দেখাশোনা করে। ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো ছাড়াও স্থায়ী দোকানেরি বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। ভ্রাম্যমাণ যারা সিগারেট বিক্রি করে, তাদেরকে একবার ধরতে পারলে দ্বিতীয়বার আর সিগারেট ফেরত দেওয়া হয় না।