‘হাজার প্রতিবাদও কি বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো?’
‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে গত ১২ এপ্রিল রাতের আঁধারে বাবার উপর হামলা চালানো হয়। গত দশ দিন ধরে বাবা আইসিইউতে। আজ যদি আমার বাবার কিছু হয়ে যেতো, হাজার প্রতিবাদের বিনিময়েও কি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কালকি।
সোমবার (২২ এপ্রিল) বিকেলে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে নোয়াখালী সুবর্ণচরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী লিটনের বাবা বশির আহমেদের উপর হামালর বিচার দাবিতে মানববন্ধন করে ঢাকাস্থ সুবর্ণচর উপজেলার শিক্ষার্থীরা। এসময় হামলার বিবরণ দেন বশির আহমেদের বড় মেয়ে মোর্শেদা আক্তার কাকলী।
মুর্শেদা কাকলি বলেন, ১২ এপ্রিল আমার বাবার ওপর হামলা হয়। আজ আমি এখানে আমার বাবার হামলার বিচারের জন্য দাঁড়িয়েছি, আমি বা আমার পরিবার যা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার বাবা ৩০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে গেছে। যেই রাজনৈতিক জীবনে কোনো লোভ কখনোই ছিল না। আমার বাবা কখনো নিজের সুবিধার জন্য রাজনীতি করেনি, আমাদের চার ভাই-বোনের পড়াশোনার জন্যেও কখনো কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নেয়নি। আমার বাবার ইচ্ছে ছিল আমরা চার ভাই-বোন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হই। বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে দুই ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বড় ভাই ঢাকা কলেজ ও আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করি।
তিনি আরো বলেন, এই যেসকল ছেলেরা আমার বাবার উপর হামলা চালিয়েছে, তারাও তো কোনো বাবার সন্তান। আমার প্রশ্ন তাদের মা-বাবার কাছে, আমার প্রশ্ন সুবর্ণ চরবাসীর কাছে, এ কেমন সন্তান গড়ছেন আপনারা। আমাদের সমাজ এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, সামান্য ক্ষমতার লোভ আর এক-দুই হাজার টাকার লোভ দেখিয়ে একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষকে খুনের চেষ্টা করতে বিবেক বাঁধলো না। এই পনেরো ষোল বছর বয়সের ছেলেদের কারা শেল্টার দিচ্ছে? কারা এদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে? পড়াশোনা করার সোনালি সময়ে কারা এদের অন্ধকারে দাবিত করছে? কেউ বলতে পারবেন আমার বাবা কোনো লোককে মেরেছে, কোনো বয়স্ক লোককে অসম্মান করেছে। তাহলে কোন সূত্র ধরে আমার বাবার উপর নির্মম হামলা চালানো হলো।
হামলার কারণ জানিয়ে কাকলি বলেন, আসন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচএম খায়রুল আলম সেলিমের সভায় গিয়েছিলেন। বাবাকে কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে কাউকে খারাপ কথা বলতে দেখিনি। কিন্তু আজ সেই বাবাকেই প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে। আজ যদি আমার বাবার কিছু হয়ে যেতো, হাজার প্রতিবাদের বিনিময়েও কি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো?
পরিবারের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমরা হাসপাতালে বেডে বসে প্রতিনিয়ত দোয়া করি, যেন কোনো সন্তান এই ধরনের অসহায় পরিবেশে না পড়ে। আমরা হাসপাতালে বসে বিচার চেয়ে যাই। আমার বাবা যদি রাজনীতি ব্যবহার করে অঢেল টাকা ও ক্যারিয়ার গড়ত, তাহলে হয়ত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বিচার হয়ে যেতো। বাবা সৎ পথে চলে আমাদের পড়াশোনা করিয়েছে বিধায় আমরা অসহায় হয়ে আছি। না পারছি খুব খারাপভাবে কিছু করতে, না পারছি নিজের আত্মসম্মানকে বলি দিতে। আজ কিছু লোক এটিকে আমাদের পারিবারিক সমস্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কাছে প্রশ্ন- রিজভি, ফয়সাল ও সাকিবের মতো পনেরো-ষোলো বয়সের ছেলেদের সাথে আমার বাবার কী ধরনের পারিবারিক শত্রুতা।
আমরা এই হামলার বিচার না পেলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। সামান্য মতে অমিল হলেই রাতের আধারে কেউ কারো ক্ষতি করবে এই ধরনের মানসিকতা হয়ে গেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসনের কাছে আমাদের বাবার উপর হামলার বিচার চাই। একই সাথে কেউ যেন চাইলে কারো উপর হামলা করতে না পেরে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নিতে তিনি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ভুক্তভোগীর সন্তান লিটন বলেন, আমার বাবা যখন রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন সন্ত্রাসীরা বাবার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। আমার বাবা দীর্ঘ আট-দশ দিন যাবত আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে। যাদের নেতৃত্বে আমার বাবার ওপর হামলা চালানো হয়েছে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা হামলার মদদদাতা ও হামলাকারীদের বিচার চাই।
সুবর্ণচরের সন্তান ও দৈনিক কালবেলার সাংবাদিক ইউসুফ আরেফিন বলেন, আমরা একসাথে বড় হয়েছি, আমরা একসাথে চলাফেরা করেছি। কখনো মারামারি করিনি, হঠাৎ করেই এই শান্ত জনপদে কী হয়েছে! একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের উপর রাতের আধারে কেনো এই ধরনের হামলা। হামলাকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রশাসন তাদের গ্রেফতার করছে না। আমরা অবিলম্বে এই হামলার সুষ্ঠু বিচার চাই।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সভাপতি শেখ মোহাম্মদ আরমানের সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য রাখেন সুবর্ণচরের বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ আকবর আলী।