জাবিতে ক্যান্টিন নিয়ে প্রাধ্যক্ষ-ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব, নেপথ্যে নানা অভিযোগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আল-বেরুনী হলের ক্যান্টিন ইজারা দেওয়াকে কেন্দ্র করে হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মো. জুলকারনাইন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন মহলে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করা শুরু করেছেন হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আড়াই মাস ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন হলের শিক্ষার্থীরা। ফলে হলের প্রাধ্যক্ষকে ক্যান্টিন চালু করার বিষয়ে তাগিদ দেন তারা। তবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রাধ্যক্ষ। এরপর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ক্যান্টিন চালু করার বিষয়টি প্রাধ্যক্ষকে অবগত করা হয়। তবুও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর প্রেক্ষিতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইয়াসিন নামে এক ব্যক্তিকে ক্যান্টিন চালানোর অনুমতি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, হলের প্রাধ্যক্ষকে একাধিকবার অবগত করার পরেও তিনি ক্যান্টিন ইজারা দেওয়ার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন প্রাধ্যক্ষ এসে আপত্তি জানান। তখন তিনি নিজের পছন্দ মতো সাত্তার নামে এক ব্যক্তির কাছে ক্যান্টিন ইজারা দিবেন বলেও জানান।
তবে হল প্রাধ্যক্ষের অভিযোগ, হল প্রশাসনের অনুমতি বা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই এক ব্যক্তিকে ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম, সাংগঠনিক সম্পাদক চিন্ময় সরকার ও স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রকিকে দায়ী করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্টিন বন্ধ ছিলো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষকে কয়েকবার জানিয়েছে। এমনকি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে। সবশেষ ভর্তি পরীক্ষার আগে ক্যান্টিন ইজারা দেওয়ার জন্য নিলাম আয়োজন করতে বলা হলেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। প্রাধ্যক্ষ নিজের পছন্দের লোককে ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব দিবেন বলেই বারবার বলা স্বত্বেও ক্যান্টিন চালু করতে দীর্ঘসূত্রিতা করছিলেন পরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিনের তালা ভেঙেছে, আর তিনি (প্রাধ্যক্ষ) ছাত্রলীগের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন।’
সাংগঠনিক সম্পাদক চিন্ময় সরকার বলেন, ‘প্রাধ্যক্ষ নিজের দায়িত্বের প্রতি উদাসীন। ছাত্রবান্ধব কোনো আচরণ তার মধ্যে পাইনি। ক্যান্টিন চালুর বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে কয়েক দফায় জানালেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এক্ষেত্রে তার দায়িত্বের প্রতি অবহেলা এবং নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল।’
এদিকে ক্যান্টিন ইজারা দেওয়াকে কেন্দ্র করে হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মো. জুলকারনাইন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্বের পেছনে পূর্বের মনোমালিন্যকে দায়ী করছেন হল সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, হলের ইমাম ও নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ এবং নতুন দোকান স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের মনোমালিন্য চলছিলো। ক্যান্টিন ইজারা দেওয়া নিয়ে হল ছাত্রলীগ ও প্রাধ্যক্ষের বনিবনা না হওয়ায় সেই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে।
অন্যদিকে হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মো. জুলকারনাইনের বিরুদ্ধে হলে জনবল নিয়োগে বাণিজ্য, টাকার ভাগ-বাটোয়ারাসহ নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিয়মিত হলে না আসা, হল সংলগ্ন লেক পরিষ্কার না করা, হলের সংস্কার কাজ শেষ না করা ও হলের সামনের রাস্তার সংস্কার কাজে গাফলতিসহ নানা অভিযোগ এনেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগ ও হল সুত্রে জানা যায়, আল-বেরুনী হলের সামনে নতুন চারটি স্থায়ী দোকান বসানো হয়েছে। এর মধ্যে, দু’টি দোকান ছাত্রলীগ নেতারা এবং দু’টি দোকান প্রাধ্যক্ষ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। দোকানপ্রতি ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা করে আদায় করেছেন প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রলীগের নেতারা। এছাড়া হলের পেছনে উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে খেলার মাঠের কাজ চলমান রয়েছে। তবে বেষ্টনী না থাকায় হলে ধুলাবালি আসার অভিযোগে কাজ বন্ধ করে দেয় শিক্ষার্থীরা। তখন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হলের টেলিভিশন কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকা নেন প্রাধ্যক্ষ। তবে তিনি হলের টেলিভিশন ক্রয় করেননি।
এদিকে গত বছরের নভেম্বর মাসে হলের পেশ ইমাম ও নিরাপত্তাকর্মী পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পদে ‘পছন্দের প্রার্থীদের’ নিয়োগ দেওয়ার জন্য স্ব স্ব প্রার্থীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তখন পেশ ইমাম পদে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে প্রাধ্যক্ষকে চাপ দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যদিও এসব বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় প্রাধ্যক্ষের কক্ষে তালা দেন হলের শিক্ষার্থীরা। ফলে নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করতে বাধ্য হন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘হলের নিয়োগসহ সকল কাজে আর্থিক সুবিধা নিতে চান প্রাধ্যক্ষ জুলকারনাইন। হলের দু’টি নিয়োগের মধ্যে দুটোতেই নিজের পছন্দের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে চান তিনি। এমনকি হলের নতুন চারটি দোকানের মধ্যে দু’টি দোকান নিজের পছন্দের লোককে দিয়েছেন প্রাধ্যক্ষ। যদিও তারা দোকানগুলো এখনও চালু করতে পারেননি।’
এছাড়া হল অফিস ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাগজপত্র স্বাক্ষর করানোর জন্য প্রাধ্যক্ষকে নিয়মিত হলে পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, হল সংশ্লিষ্ট কোনো কাগজপত্র স্বাক্ষর করার প্রয়োজন হলে হলের কর্মচারীরা প্রাধ্যক্ষের বাসায় নিয়ে যান। সেখান থেকে স্বাক্ষর নিয়ে আসতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলের কোনো সমস্যার বিষয়ে প্রাধ্যক্ষ স্যারকে অবগত করলেও তিনি গুরুত্ব দেন না। হল সংলগ্ন লেক অপরিষ্কার থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে, সে বিষয়টি নিয়েও তিনি উদাসীন। এছাড়া হলের ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকের সংস্কার কাজ শেষ করা হলেও ‘সি’ ও ‘ডি’ ব্লকের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। সে বিষয়েও তিনি ব্যবস্থা নেননি।’
সার্বিক বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মো. জুলকারনাইন বলেন, ‘তাদের (ছাত্রলীগ নেতাদের) আনীত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মানহানিকর। এসবের সাথে আমি কখনও জড়িত ছিলাম না। কিছু শিক্ষার্থী ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরেও তারা অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছে। তাই তাদের হল থেকে বের করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেটাকে বাধা দেওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাদের অন্যায়-অপকর্মে পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। তাদের অপকর্মগুলো আমি সমর্থন করি না বলেই আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলছে। এখানে আমার বদলে অন্য কোনো প্রাধ্যক্ষ থাকলে তার সাথেও একই কাজ করতো।’
ক্যান্টিন ইজারা দেওয়ার বিষয়ে সিকদার মো. জুলকারনাইন বলেন, ‘তারা আমাকে জানিয়েছে, তবে ক্যান্টিন ইজারা দেওয়ার অফিসিয়াল প্রক্রিয়া চলছিলো। তারমধ্যেই যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই ছাত্রলীগের নেতারা হলের ক্যান্টিন একজনের হাতে তুলে দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি প্রাধ্যক্ষ কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি।’
নিজের পছন্দের লোককে ক্যান্টিন ইজারা দিতে চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নিজের কোনো লোক নাই। তবে আমাদের একজন সাবেক শিক্ষার্থী (সাত্তার) ক্যান্টিন পরিচালনার জন্য আবেদন করেছে। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে বিবেচনায় রেখেছিলাম।’