বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে ব্যঙ্গচিত্র, ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা বহিষ্কার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি মুছে ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনের ঘটনায় ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের দুই নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনে থানায় মামলা করেছে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) আশুলিয়া থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বহিষ্কৃত নেতারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ ব্যাচের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অমর্ত্য রায় ও ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি। অমর্ত্য ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি ও ঋদ্ধ সাধারণ সম্পাদক।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা শেষে রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেট সচিব আবু হাসান বলেছিলেন, সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে পূর্বে থেকে আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি মুছে ফেলার ঘটনায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অমর্ত্য রায় ও ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলিকে এক বছর করে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদ ভবনের দেয়ালে পূর্বে আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুছে একটি ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের নেতাকর্মীরা। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদে এই চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতারা। ব্যঙ্গচিত্রে একটি নারীর অবয়ব, ছয়টি মাথার খুলিসহ একটি পতাকা আঁকা হয়। এর পাশেই লিখা হয় ‘ধর্ষণ ও স্বৈরাচার থেকে আজাদী’। এছাড়া ব্যঙ্গচিত্রের নিচে ছাত্র ইউনিয়নের নাম লিখা হয়।
এই ব্যঙ্গচিত্রে থাকা নারীর অবয়বের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পূর্বের প্রতিকৃতি মুছে ফেলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে অনশনে বসেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম। ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনের পেছনে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে তিনি প্রায় ৮৩ ঘণ্টা এক টানা অনশন করেন। এক পর্যায়ে উপাচার্য এসে এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত শেষে সিন্ডিকেট সভায় শাস্তি প্রদানের আশ্বাস দিলে অনশন ভাঙেন ছাত্রলীগের এই নেতা।
এছাড়া এই ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের দুই সংগঠন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
শাস্তি ঘোষণার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক এনাম বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি প্রদান করায় ধন্যবাদ জানাই। এই রায়ের মাধ্যমে ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মী খুশি। এটা হওয়া উচিত ছিল।
জাতির পিতাকে অবমাননা করলে পৃথিবীর যেই প্রান্তেই হোক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার প্রতিবাদ করবে। আজকে আমরা সত্যিই আনন্দিত।
শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ
দুই নেতার বহিষ্কারাদেশ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একদল প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বিকেলে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ সমাবেশ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতার বহিষ্কারের আদেশ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গৃহবধূকে ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে একটি প্রতিবাদী দেয়ালচিত্র আঁকার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। তাঁদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা করেছে।
সমাবেশে বক্তারা দুই ছাত্রনেতার স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম চালু রাখার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি না করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
সমাবেশে বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কাজী সাজ্জাদ জহির, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাসুদ ইমরান, প্রাক্তন শিক্ষার্থী মনি জামান, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, সোহেল জাফর, পাভেল পার্থ, কল্লোল বণিক, অনিন্দ্য আরিফ, মাহি মাহফুজ, সৌমিত চন্দ চন্দ্র জয়দ্বীপ, সিনা হাসান, তন্ময় ধর, দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত, কাব্য কৃত্তিকা, অলিউর সান প্রমুখ।
ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল
ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কারের আদেশ বাতিলের দাবিতে মশাল মিছিল করেছেন বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে মশাল মিছিল বের করা হয়।
মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবন ও পরিবহণ চত্বর ঘুরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। পরে সেখানে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারীরা।
সমাবেশে তারা সংগঠনটির সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলীর বহিষ্কারাদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাদী হয়ে মামলা করার দুরভিসন্ধি বাতিলের দাবি জানান।
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তাপসী দে প্রাপ্তি বলেন, বঙ্গবন্ধুর চেতনা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পুঁজি নয়। বঙ্গবন্ধু সবার। গ্রাফিতি থাকলে সেখানে মুছে আরেকটি করা হবে– এটাই নিয়ম এবং এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে আসছে।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করার পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোস্তাফা ফিরোজ ও প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান। কিন্তু আন্দোলনকারীরা উপাচার্য ছাড়া বাকিদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এর পর আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।