ধর্ষণকাণ্ডে ৪র্থ দিনেও উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় চতুর্থ দিনেও উত্তপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস। গত শনিবার এ ঘটনার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করে নিপীড়নমুক্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে দিনব্যাপী বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট সিনেটরদের মানববন্ধন
মানববন্ধনে জাবির সাবেক উপাচার্য ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির ধর্ষকদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলেন, আমরা এখানে ধর্ষণ ও গণরুমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কেবল ২৫০০ নয়, খুঁজে দেখলে প্রায় পাঁচ হাজার অছাত্র পাওয়া যাবে। অছাত্ররা হলে অবস্থান করায় বৈধ শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে হল থেকে গণরুম উচ্ছেদ করতে হবে। হলের প্রাধ্যক্ষ, ওয়ার্ডেনদের হলে থাকতে হবে। হলে ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে যেন রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ছেলে মেয়েরা ফিরে আসে। হলের পাশের দোকানসমূহে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অটোরিকশা চলাচল সীমিত করতে হবে ।
বর্তমান উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের (সিনেটর) ভোটে নির্বাচিত উপাচার্য। আপনি কেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পান। আমরা আপনার সাথে আছি। আপনি মনে রাখবেন পাঁচ দিন মানে পাঁচ দিনই। এরপর যেন অছাত্র, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, বহিরাগত একজনও আবাসিক হলে স্থান না পায়। ২১ টা হলের প্রভোস্ট একসঙ্গে যদি তাদের হলে অভিযান পরিচালনা করেন তাহলে কোন অবৈধ শিক্ষার্থীর সাহস নেই তাদের সামনে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক ড. শামছুল আলম বলেন, আজ আমরা বিভিন্ন দল মতের সবাই একত্রিত হয়েছি। আমরা চাই নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অপকর্মের দায় উপাচার্যের। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষক জনির বিরুদ্ধেও নৈতিক স্খলনের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাকে এখনো বহিষ্কার কিংবা সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়নি। আমরা চাই অবিলম্বে তার ব্যাপারে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে গণরুম সংস্কৃতি দূর করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে তোলা দাবিগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করুন।
শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন
নিপীড়ক শিক্ষক জনির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে দুপুর ১২টায় শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন করেছে। এসময় নেতৃবৃন্দ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই অভিযুক্ত তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও ৬ জনের সনদ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু দেড় বছর হয়ে গেলেও যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার শেষ করছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা এবং স্ট্রাকচার্ড কমিটির কাছেও লিখিত বক্তব্যে জনি সব স্বীকার করেছেন। কিন্তু সাময়িক বহিষ্কার তো দূরে থাক বহাল তবিয়তে আছেন জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি।
বিচারের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সদিচ্ছার অভাব দেখছেন স্ট্রাকচার্ড কমিটির একজন সদস্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান জনি তার বিরুদ্ধে উঠা যৌন নিপীড়নের সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আমরা কমিটির সদস্যরাও নিশ্চিত হয়েছি তিনি অপরাধী। তার কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের বিক্ষোভ
দুপুর দেড়টায় টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ‘নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ’র সদস্যরা ধর্ষণ, নিপীড়নমুক্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিক্ষোভে অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘বিশ্ববিদয়ালয়ের সকল অরাজকতাকে অবশ্যই কঠোর হস্তে দমন করা হবে। অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন ধর্ষক হয়ে উঠছে সেই কারণগুলো পর্যবেক্ষণ করে যৌন নিপীড়ক এবং ধর্ষকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের সদস্যসচিব মাহফুজ ইসলাম মেঘ বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক, তবুও একজন ছাত্র তৃতীয় বর্ষে এসে হলে সিট পাচ্ছেনা। অথচ হলগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার অছাত্র অবস্থান করে আছে, আর এই অছাত্রদের দ্বারাই বেশি অপকর্ম ঘটে। ঘটে ধর্ষণ গুম-খুনের মতো ঘটনাও। ধর্ষক মোস্তাফিজও একজন অছাত্র। অছাত্ররা বিতাড়িত হলেই বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধমুক্ত হবে।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, জাবির এ ঘটনা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক হয়ে দাঁড়িয়েছি। এসবের সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখবো।
ছাত্র ইউনিয়নের কালো পতাকা মিছিল ও মানববন্ধন
বিচার নিশ্চিতকরণ ও ক্যাম্পাসকে সকল অপরাধের ছত্রছায়া থেকে মুক্তির দাবিতে কালো পতাকা মিছিল করেছে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদ। মিছিলটি মুরাদ চত্বর থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
সাংস্কৃতিক জোটের বিক্ষোভ
বিকাল পাঁচটায় সাংস্কৃতিক জোটের সদস্যরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। বিক্ষোভটি শহিদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা প্রদক্ষিণ করে রেজিস্ট্রার ভবনে গিয়ে শেষ হয়।