রাবিতে ১৫ দিনে ৯৮ শিক্ষার্থীর জন্ডিস, নলকূপে দুর্গন্ধযুক্ত পানি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১৭টি আবাসিক হলের নলকূপ ও ট্যাপকলের পানিতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। বিকল্প হিসেবে হলগুলোয় সাবমারসিবল পাম্প থাকলেও পানি সরবরাহের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। ফলে নিয়মিত নিরাপদ পানি পান করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। এতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের। এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে পানিবাহিত হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস (জন্ডিস) রোগে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেলগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন ও একই পানি দিয়ে একাধিক প্লেট পরিষ্কার এবং একটি গ্লাস দিয়ে অনেকেই পানি পান করায় এসব রোগ ছড়াচ্ছে বলে জানান মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসকরা। জানা গেছে, হোটেলগুলোর রান্নার কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ট্যাপকল বা নলকূপ থেকে পানি নিয়ে রান্নার কাজ করছেন দোকানিরা। একই পানি পান করাচ্ছেন শিক্ষার্থীদেরকেও। ফলে জন্ডিসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের উপ-প্রধান চিকিৎসক মো. লোমান মঞ্জু অপুর তথ্য মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ দিনে পরীক্ষা করানো ২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৮ জন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন। দূষিত পানি ও ফুটপাতের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৭টি আবাসিক হলে বিশুদ্ধ পানি খেতে শিক্ষার্থীদের জন্য নলকূপ রয়েছে প্রায় ১১২টি। এর অধিকাংশই মরিচা ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যেসব নলকূপ সচল, তাতেও বিশুদ্ধ পানির দেখা মিলছে না। সেখানে রয়েছে প্রচুর আয়রন ও ময়লা। শিক্ষার্থীদের রান্না বা গোসলের জন্য রয়েছে ট্যাপকল। এতেও রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত ও লালচে পানি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলেই বিশুদ্ধ পানির জন্য রয়েছে সাবমারসিবল পাম্প। কিন্তু দিনে তিনবার নির্দিষ্ট সময় ২০-২৫ মিনিটের জন্য চালু করা হয়। ফলে এ সময় যারা হলে থাকেন, তারাই শুধু নিরাপদ পানি সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস-পরীক্ষা, টিউশন ও ক্যাম্পাসে থাকায় সাবমারসিবলের পানি সংগ্রহ করতে পারেন না। ফলে হলে এসে নলকূপের পানি খেতে হয় তাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ দিনে পরীক্ষা করানো ২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৮ জন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন। দূষিত পানি ও ফুটপাতের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন
শেরেবাংলা হলে থাকেন নৃবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ। তিনি বলেন, ‘আমি সকালেও খাবারের জন্য নলকূপ থেকে পানি নিয়েছি। পানিতে খুবই ময়লা এবং দুর্গন্ধ থাকছে, ফলে পানি খাওয়া যাচ্ছে না। সাবমারসিবল পাম্পের পানি না পাওয়ায় এসব মাঝে মাঝে পান করতে হয় আমাদের। ফলে আমাদের মাঝে অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শীতের কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক সময় পানি পেতেও আমাদের কষ্ট হয়।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলের নলকূপগুলোর গভীরতা ১০০-১৫০ ফুট হওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না তারা। নলকূপ থেকে ময়লা ও লালচে রংয়ের পানি বের হয়। মাঝেমধ্যে পানিতে দুর্গন্ধ থাকে। নলকূপ ছাড়া ট্যাপকলের পানিতে আরও বেশি ময়লা ও দুর্গন্ধ থাকে। পানি সরবরাহ করা ট্যাংকিগুলো খুবই অপরিষ্কার। ফলে সব সময় সেখানে ময়লা জমে থাকে।
তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, অ্যাকাডেমিক ভবন, ক্যাম্পাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ক্যাম্পাসের হোটেলগুলোর আশপাশে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া যেহেতু পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, ফলে আবাসিক হলগুলোতে দিনে তিনবেলা না করে সারাদিনের জন্য সাবমারসিবল পাম্প চালু রাখা দরকার। হোটেলগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে প্রশাসন থেকে অভিযান পরিচালনা করা এবং নিয়মিত ট্যাপকলের ট্যাংকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাও জরিুরি।
অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাসির বলেন, ‘নিরাপদ পানি পান করার জন্য হলগুলোতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হলেও সেখান থেকে অনেক সময় আমরা সরবরাহ পাই না। দিনে তিনবেলা চালু করা হয় এসব পাম্প। অনেক সময় আমরা বিভিন্ন কাজে হলের বাহিরে থাকি। হলে ফিরে নলকূপ থেকে আয়রনযুক্ত পানি খেতে হয় আমাদের। এসব দূষিত পানি পান করার ফলেই হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস ছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।’
মন্নুজান হলে থাকেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা হলে অবস্থান করছি এবং খাবারের দোকানের পানি পান করছি, সেটি আসলে আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। এখানে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াও মানা হচ্ছে না। আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি, যাতে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি। এজন্য আমাদের আবাসিক হল, অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক তবিবুর রহমান শেখ বলেন, ‘শীতকালে ঠান্ডার কারণে মানুষ চলাচল কম করে বিধায় রক্ত চলাচলও কম করে। হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসের কারণে জন্ডিস হচ্ছে। এটি মূলত পানিবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে নিরাময় পেতে হলে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের সচেতনতা। যেসব শিক্ষার্থী হলে থাকে, তাদের সাবমারসিবলের পানি খেতে হবে। ক্যাম্পাসে হোটেল ও ক্যান্টিন মালিকদের উচিৎ নলকূপ বা সাবমারসিবলের পানি দিয়ে রান্নার কাজ করা।’
আরো পড়ুন: উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন চবি শিক্ষকরা
বিশুদ্ধ পানির জন্য সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমোদনক্রমে প্রতিটি হলেই আমরা সুপেয় পানির জন্য সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করেছি। যদি হলে দূষিত পানির দেখা মেলে, তাহলে প্রভোস্ট আমাদেরকে অবহিত করলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রদের জন্য তা সমাধান করার চেষ্টা করব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘অনেকগুলো হলে সাবমারসিবল পাম্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পানির মূল ট্যাংকিতে ময়লা জমে থাকায় হলগুলোতেও ময়লা পানি আসে। লাইনগুলোতে আয়রন জমে আছে। ফলে নিরাপদ পানি পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ব্লকে ব্লকে সাবমারসিবলের লাইন দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আলোচনা করতে হল প্রভোস্টদের নিয়ে ৮ তারিখ মিটিং আছে। পানিবাহিত রোগ নিরসনে আমরাও কাজ করছি।’