২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:২৫

১২৮ গণরুমে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী, কারাবন্দিদের অর্ধেক জায়গাও বরাদ্দ নেই যাদের ভাগ্যে

একবুক স্বপ্ন নিয়ে নবীন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেও শুরুতেই সে স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় গণরুম  © টিডিসি ফটো

“হলের গণরুমে শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়, যা জেলখানার কারাবন্দিকেও হার মানায়। জেলে যেমন স্বাধীনতা নেই, গণরুমও তেমন। জেলখানায় কারাবন্দিদের দিনে তিনবার গণনা করা হয়, তেমনি গণরুমের সবাইকে গুণে গুণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের জোর-জবরদস্তি করে প্রোগ্রামে নিয়ে যায়। নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় গেস্টরুমে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলের গণরুমে থাকা ও জেলখানায় কারাবন্দি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক শিক্ষার্থী রাজু আহমেদের। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি গণরুম ও কারাবাসের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব শিক্ষার্থীদের জেলখানায় কারাবন্দি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা না থাকলেও রয়েছে তার চেয়েও ভয়াবহ গণরুমে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা।

দেশের কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম জায়গা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৬ ফুট করে। আর স্কয়ার ফিট (বর্গফুট) হিসেবে সেটি দাঁড়ায় ৩৬-এ। কিন্তু ঢাবির আবাসিক হলের গণরুমের থাকার জন্য একজন শিক্ষার্থী গড়ে ১৬ থেকে ১৭ স্কয়ার ফিট থাকার জায়গা পান। ফলে কারাগারে থাকা একজন কয়েদির অর্ধেক জায়গাও পান না গণরুমের শিক্ষার্থীরা। 

গণরুমে শিক্ষার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন (ফাইল ফটো)

একবুক স্বপ্ন নিয়ে নবীন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেও শুরুতেই সে স্বপ্ন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় গণরুম (যেখানে পলিটিক্যালি ছাত্রদের গাদাগাদি করে থাকতে হয় এবং এর বিনিময়ে ছাত্রসংগঠনগুলো জোর করে তাদের দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায়) এবং গেস্টরুম (যেখানে শিক্ষার্থীদের আচরণ শেখানোর নামে সিনিয়ররা জুনিয়রদের নির্যাতন করে)।

হিসেব নিকেশের বাইরে গিয়ে এসব শিক্ষার্থীরা কোনো রকমে গণরুমে শোয়ার জায়গা পেলেও তাদের জন্য থাকে না কোনো পড়াশোনার পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের যেখানে শোয়ার জন্য একটি জায়গা জোগাড় করাই রীতিমতো জীবন ও যুদ্ধের উপসংহার সেখানে একটি পড়ার টেবিল স্থাপন করা তো বিলাসিতাই বটে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে ১২৮টি গণরুমের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান বলছে, ঢাবির মোট ১৯টি হলের মধ্যে ১৮টি হল নিয়ন্ত্রণ করে সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর বাহিরে বাকি একটি ইন্টারন্যাশনাল হলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে প্রশাসনের অধীনে। এই ১৮টি হলের ১২৮টি গণরুমে থাকেন প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী। এদের অধিকাংশই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের। বিভিন্ন আয়তনের ছোট-বড় গণরুমে বসবাস করেন গড়ে ২০ দশমিক ৮৫ জন করে। 

এর মধ্যে ছেলেদের ১৩টি হলে ৮৫টি গণরুমে বর্তমানে ১ হাজার ৮০০-এর অধিক শিক্ষার্থী থাকেন। আর মেয়েদের ৫টি হলে ৪৩টি গণরুমে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসেন, সেই স্বপ্ন বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় গণরুমেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় বিষয় জেনেও তারা এ সংস্কৃতি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না। কারণ গণরুমের সঙ্গে রাজনীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য দায়িত্ব নেওয়া উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল গণরুমের এই সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তনে কথা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন।

একসময় গণরুমের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কথা বলা সৈকত এখন শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে (ফাইল ফটো)

গণরুমে থাকা ও জেলখানায় কারাবন্দি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে মো. ফিরোজ আলম নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এক শিক্ষার্থীর। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তার গণরুম ও কারাবাসের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ১ম বর্ষের পুরোটা সময়ই সূর্যসেন হলের গণরুমে ছিলাম। যেখানে একটি সিঙ্গেল খাটে দুইজন থাকতে হতো, যা প্রশস্ত ৪ ফিট আর লম্বায় ৬ ফিট হবে। মাঝে মাঝে দুই খাট একত্রিত করে চারজনের এই সংকীর্ণ জায়গায় অনেক সময় ৫ জনও থেকেছি। যেখানে চিৎ হয়ে শোয়ার সুযোগ ছিল না, তাই কাত হয়ে ঘুমাতে হতো। 

“তার চেয়ে জেলখানার সেলে ভালো ছিলাম। আমাদের জন্য পূর্বেই খালি করে রাখা একজনের জন্য বরাদ্দ একেকটি সেলে প্রথম ৪-৫ দিন ৮-১০ জন ছিলাম। তখন অনেকের অসুবিধা হলে আমার সমস্যা হয়নি কেননা এর চেয়ে কষ্ট করে গণরুমে ১৪-১৫ মাস কাটিয়েছি। ৪-৫ দিন পর সেল থেকে চালান শুরু হয় এবং লোক সংখ্যা কমতে থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে ৪-৫ জনে দাঁড়ায়। রাত ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তাম কেননা তখন লাইট বন্ধ করে দিত কিন্তু গণরুমে ১২-১টার আগে ঘুমানোর কোনো সুযোগই ছিল না।”

অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তিনি আরও বলেন, জেলখানার সেলের মধ্যে ৪-৫ জনের জন্য আলাদা ওয়াশরুম ছিল কিন্তু গণরুমের জন্য কোনো আলাদা ওয়াশরুম, নেই সিরিয়াল রেখে গোসল করতে হতো। এরমধ্যে আবার সিনিয়র আসলে তাকে সন্তুষ্ট রাখতে আগে সুযোগ দিতে হতো নয় তো গেস্টরুম কিংবা মিনি গেস্টরুমে কোনো একটি অজুহাত দেখিয়ে টর্চার করতেন। জেলখানায় এরকম কোনো নিয়ম বা ভয়ের বাধ্যবাধকতা ছিল না।

মাস্টারদা সূর্য সেন 
মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ১৮টি গণরুমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের দুইশ’র অধিক শিক্ষার্থী থাকেন। তার মধ্যে ২২৬, ৩২৬, ৪২৬, ৫২৬, ৬২৬-এ রুমগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথাক্রমে ১৬ ও ১২ ফুট। এর মধ্যে ২২৬ নম্বর রুমে ১২ জন, ৩২৬ নম্বর রুমে ১০ জন, ৪২৬ নম্বর রুমে ১০ জন, ৫২৬ নম্বর রুমে ১৬ জন, ৬২৬ নম্বর রুমে ৮ জন; এ ৫ রুমে মোট ৫৬ জন শিক্ষার্থী থাকেন। এই ৫ রুমের মোট আয়তন ৯৬০ স্কয়ার ফিট। গড়ে একজন শিক্ষার্থী থাকার জন্য জায়গা পায় ১৭ স্কয়ার ফিট।

একই হলের ২২৬ এর ক, ৩২৬ ক, ৪২৬ এর ক, ৫২৬ এর  ক, ৬২৬ এর ক এর রুমগুলো হলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৭ ও ১০ ফুট। মোট শিক্ষার্থী থাকেন ৫০ জন। এ রুমগুলোর মোট আয়তন ৮৫০ স্কয়ার ফিট। গড়ে একজন শিক্ষার্থী জায়গা পান ১৭ স্কয়ার ফিট। ২০১ এর ক, ৩০১ এর ক, ৪০১ এর ক, ৫০১ এর ক এ রুমগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৫/১১ ফুট। রুমগুলোর মোট আয়তন ৬৬০ স্কয়ার ফিট। মোট শিক্ষার্থী থাকেন ৪০ জন। গড়ে একজন শিক্ষার্থী পান ১৬ স্কয়ার ফিট। এছাড়াও ৩৪৯, ৪৪৯, ৫৪৯ এ রুমগুলো দৈর্ঘ্য/প্রস্থে ২১/১০ ফুট। মোট শিক্ষার্থী থাকে ৩২ জন। গড়ে একজন শিক্ষার্থী থাকার জায়গা পান ১৯ স্কয়ার ফিট।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ১১টি গণরুমে মোট প্রায় ১৩৪ জন শিক্ষার্থী থাকে। এ হলের অধিকাংশ রুম মাস্টারদা সূর্যসেন হলের মতো। প্রতিরুমে গড়ে ১২ জন শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এরাও গড়ে ১৭ স্কয়ার ফিট জায়গা পায়।  

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ৮টি গণরুমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ১৮০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আছে। গড়ে একটি রুমে ২২ জন শিক্ষার্থী থাকে। গণরুমের মোট আয়তন ১ হাজার ৩৫০ স্কয়ার ফিট। থাকার জন্য গড়ে ১২ স্কয়ার ফিটের বেশি জায়গা পান না এ হলের শিক্ষার্থীরা। 

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জামিলুর রুহিত বলেন, গণরুম একটি অভিশাপ। গণরুমের জন্য একমাত্র দায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন। গণরুম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আইন আর অমানুষ, অমানবিক শিক্ষকদের সদিচ্ছার অভাবে বেঁচে থাকা একটা কীট। দু-দিন পরপর এটা নিয়ে আওয়াজ উঠে। কিন্তু রিপ্লেস করার চিন্তা করে না কেউ। বিশেষ করে শিক্ষক শ্রেণি। রাজনীতির কালো দিককে দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করে মাঠ প্রশাসনের ব্যর্থতা আড়াল করা হচ্ছে। যদি হল সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা নতুন ভবন তৈরি না করেন তবে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক আমাদের গণরুমেই থাকতে হবে।

স্যার এ এফ রহমান হল
স্যার এ এফ রহমান হলের ৭টি গণরুমে ১৪২ জন শিক্ষার্থী থাকে। প্রত্যেক গণরুমের আয়তন দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২০ ও ১৮ ফুট। মোট আয়তন ২ হাজার ৫২০ স্কয়ার ফিট। গড়ে একজন শিক্ষার্থী থাকেন ১৭ স্কয়ার ফিট। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল
বঙ্গবন্ধু হলে ৬টি গণরুমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ১৫০ এর অধিক শিক্ষার্থী থাকেন। এই হলের শিক্ষার্থীরা আসন সংকটের কারণে টিভি রুমে থাকতে বাধ্য হয়। গড়ে একটি রুমে ২৫ জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হয়।  

বিজয় একাত্তর হল
বিজয় একাত্তর হলের মেঘনা ব্লকে বড় এক রুমেই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের প্রায় ১৫০ শিক্ষার্থী থাকেন। এটি ঢাবির বৃহত্তম গণরুম হিসেবে পরিচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আবাসন সংকটের কারণে একটি গণরুমে ১৫০-এর অধিক শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে নিজের জামাকাপড়-লাগেজ-ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ঠিকভাবে রাখা সম্ভব হয় না। একাধিক শিক্ষার্থী একসাথে থাকার কারণে অনেকের মোবাইল ল্যাপটপসহ অন্যান্য সামগ্রী চুরিও হয় নিয়মিত। তিনি আরও বলেন, ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ সেশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবশালী বড় ভাইয়েরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমগুলো দখল করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, যার ফলস্বরূপ আমাদের গণরুমে থাকতে হচ্ছে।  

কবি জসীম উদ্‌দীন হল
এই হলে মোট ৮টি গণরুমে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন। এসব রুমে প্রায় ১৩০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে প্রতি রুমে ১৬ জন শিক্ষার্থী থাকে। 

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৬টি গণরুমে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের প্রায় ১৪৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ২৪ জন শিক্ষার্থী থাকেন।

জগন্নাথ হল
জগন্নাথ হলের ৫টি গণরুমে ৮০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ১৬ জন শিক্ষার্থী থাকেন।

অমর একুশে হল
অমর একুশে হলের ২টি গণরুমে ৫৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন। এছাড়া ক্রীড়া ও টিভি কক্ষে প্রথম বর্ষের ৭০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ৫৫ জন শিক্ষার্থীর আবাসস্থল।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ৬টি গণরুমে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ২৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন।  

ফজলুল হক মুসলিম হল
ফজলুল হক মুসলিম হলে ৬টি গণরুমে ১২০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ২০ জন শিক্ষার্থী থাকে।  

রোকেয়া হল
রোকেয়া হল ১৩টি গণরুম রয়েছে। সেখানে প্রতিরুমে প্রথম ও  দ্বিতীয় বর্ষ  মোট ১৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করে। গড়ে এক রুমে ১২ জন শিক্ষার্থীর আবাসস্থল। 

শামসুন নাহার হল
শামসুন নাহার হলে ১১টি গণরুমে মোট ১৪০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। তার মধ্যে ১০টি রুম হল প্রশাসনের। যেখানে ৮০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। ২৪১ নম্বর কক্ষটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে যেখানে ৬০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। শামসুর নাহার হলের গণরুম নাম্বারগুলো হলো ১৪১, ২৪১, ৩৪১, ৪৪১, ৫৪১, ১০২, ২০২, ৩০২, ৪০২, ৫০২। গড়ে ১২ জন করে করে থাকেন এসব রুমে। 

কবি সুফিয়া কামাল হল
কবি সুফিয়া কামাল হল প্রেসিডেন্ট (শাখা ছাত্রলীগ) ব্লকে ‘হল রুমে’ বড় ১টি গণরুমে ৭০ জন। সেক্রেটারি ব্লকে ১টি রুমে ৩০ জন শিক্ষার্থীর আবাস। এছাড়া ওই হলের প্রশাসনিক ভবনের চার তলার কয়েকটি গণরুমে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী বসবাস করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আবাসন সংকট এবং হল প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের একজনের জায়গায় ৩ জনকে থাকতে হয়। গণরুমগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত কোনো পরিবেশ নাই। গণরুমে থাকার সুবাদে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে বাধ্য হয়ে যেতে হয়, যার ফলে পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক প্রোগ্রামে না গেলে অনেক চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং জবাবদিহিতা চেয়ে গেস্টরুম ডাকা হয়। মারধর না করলেও প্রচুর গালিগালাজ করা হয়।

 

কবি জসীম উদ্‌দীন হল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহিন খান

কবি সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পূজা কর্মকার বলেন, আবাসন সমস্যা প্রত্যেক হলেই আসে তবে কবি সুফিয়া কামাল হলে অনেক কম। এ হলের কোনো শিক্ষার্থী ফ্লোরিং করে থাকে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থী বেডে থাকে এবং প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। অস্বাস্থ্যকর কোনো পরিবেশ সুফিয়া কামাল হলে নেই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দায়িত্ব প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সুযোগ সুবিধায় হেল্প করা। হেল্প করার পরিপ্রেক্ষিতে একজন শিক্ষার্থীর যখন সিটের সংকট হয় তখন আমরাই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

জোর করে প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,  আমরা কোনো শিক্ষার্থীকে জোর করে প্রোগ্রামে নিয়ে যাই না। যার ভালো লাগবে সেই তো প্রোগ্রামে যাবে। আমি গত ৫ মাস কোনো প্রোগ্রামে যায়নি।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৫টি গণরুমে মোট ৮৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন। গড়ে এক রুমে ১৭ জন করে ছাত্রী অবস্থান করছেন এই হলে।  

বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল
সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে এই হলের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ৯ টি গণরুম। মোট ৮০ শিক্ষার্থী। গড়ে প্রায় ২০ জন করে। আর ঝুঁকিপূর্ণ শিকদার মনোয়ারা ভবনে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা মোট ১৮০ জন শিক্ষার্থী থাকেন।

মনোয়ারা ভবনে পলিটিক্যাল গণরুম,বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের ১০৬ নম্বর রুমে ২০ জন, ১০৭ নম্বর রুমে ২০ জন, ১০৮ নম্বর রুমে ২০ জন, ১০৯ নম্বর রুমে ২০ জন, ১১০ নম্বর রুমে ২০ জন। মেইন বিল্ডিংয়ে ১০৬ নম্বর রুম থেকে ১১০ নম্বর রুমে পর্যন্ত এক রুমে ২০ জন করে শিক্ষার্থী থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছু বাংলাদেশ কুয়েত মন্ত্রী হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাবির সবচেয়ে  ঝুঁকিপূর্ণ এবং নানা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হল হলো কুয়েত মৈত্রী হল। এ হলে ধারণক্ষমতার চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা চাই এই ভবন থেকে কিছু শিক্ষার্থী অন্য হলগুলোতে শিফট করুক। হল প্রশাসন থেকে পদক্ষেপ নিলেও পলিটিক্যাল নেত্রীরা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। আর্থিক সংকটের কারণে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী এই হলে অবস্থান করছে। 

ঢাবির হলের গণরুম (ফাইল ফটো)

এদিকে, শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) রাতে মেহেরুন মীম নামে এই হলের এক ছাত্রী ফেসবুকে লেখেন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল থেকে বলছি। গণরুমে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বেডের উপরে প্রতিটা আনাচে কানাচে তেলাপোকার এত বেশি উপদ্রব যে এখন মশারি টানিয়ে তার ভিতরে বসে কান্না পাচ্ছে তেলাপোকা আর ছাড়পোকার যন্ত্রণায়। প্রায় বেশ কয়েকমাস ধরে এই সমস্যার সাথে বসবাস করছি। এতদিন তবুও খাটের নিচে ছিল এখন ত ঘুমাতেও ভয় লাগে কখন যেন নাক মুখ দিয়ে তেলাপোকা ঢুকে যায়৷ রুমে কোনো খাবার রাখা যায় না তেলাপোকার জন্য। আমিতো রান্না করা ছেড়েই দিয়েছি প্রায়। ম্যামদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার এসে বলে গেল ছাড়পোকার ওষুধ দিবে এই শীতকালীন বন্ধে সেটাও দেওয়া হচ্ছে না। এখন প্রতিটা জিনিসপত্রে এই তেলাপোকার উপদ্রব আমি ক্রমাগত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি এই পরিবেশে খুবই বিরক্ত লাগছে। ঘুম বাদ দিয়ে এখন তেলাপোকা খুঁজছি আর কান্না পাচ্ছে।

সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল
একসময় এই হলের বারান্দার গণরুমে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করতো। গত নভেম্বর মাসে এই গণরুম উচ্ছেদ করে হল প্রশাসন। তবে বর্তমানে হলের গেমস রুমে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী থাকছেন।

ঢাবির গণরুমের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. আইনুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণরুমে থাকবে এটা কখনোই গ্রহণীয় নয়। গণরুমে আমাদেরকে শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করে। তারা যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসে, তাদেরকে যখন গণরুমে পাঠানো নয়, সেই স্বপ্নের জায়গাতে বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটানো হয়। 

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জানে রাজনীতির সাথে গণরুমের একটি সম্পর্ক আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়তো বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কারণে কোন উদ্যোগ নেয় না কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। শিক্ষার্থী সংখ্যা কমিয়ে প্রতিটি হলের গণরুম সংকট নিরসন করা দরকার।

ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিএনপির আমলেও ঢাবিতে গণরুম ছিল, তখন আবাসন সমস্যা ছিল। প্রতিটি গণরুমে ৭-৮ জন অবস্থান করতো,  কিন্তু এখন ছাত্রলীগ জোরপূর্বক একরুমে ১৫ জনের অধিক শিক্ষার্থীকে রাখছে। ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রলীগ তাদের আধিপত্য বিস্তার করা এবং তাদের নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমগুলো দখল করেছে  এবং তাদেরকে গণরুমে প্রেরণ করেছে।

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের আবাসন সংকটের কারণেই গণরুম তৈরি হয়। আমাদের যে সংকট তা স্বীকার করে নিতে হবে। আমরা খুব দ্রুতই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো। নতুন দুইটি হল, বঙ্গবন্ধু হল এবং জগন্নাথ হলের নির্মাণ কাজ শেষ হলে আমরা সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবো। গণরুম সংকট নির্মূলের জন্য এই দুইটি হল বড় ভূমিকা রাখবে।

তিনি আরও বলেন, ঢাবি প্রশাসন শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমানোর কারণে পূর্বের তুলনায় গণরুমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। আগে যেখানে একটি গণরুমে ২৫-৩০ জন থাকতো সেখানে এখন ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী অবস্থান করে। অনেক সময় সাধারণ শিক্ষার্থীর বরাদ্দকৃত রুমে সিনিয়র থাকায় জুনিয়র সম্মান রক্ষার্থে রুমে উঠতে চায় না।

কবি জসীম উদ্‌দীন হল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহিন খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু কিছু রুম আছে যেখানের পরিমাণের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে। তাদের বিষয়টি হল প্রশাসন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ  করছে। তাদের রুমে কোনো সমস্যা আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা দেখভাল করছি।

তিনি আরও বলেন, অন্যান্য হলের তুলনায় কবি জসিম উদ্দিন হলের সার্বিক পরিস্থিতি অনেক ভালো। কিন্তু এ হলে কিছু রুম আছে যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে, এটি একটি বাস্তবতা, কারণ আমার হলের যে সিটসংখ্যা তার তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। একটি রুমে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকার কথা তার থেকে অধিক শিক্ষার্থী রুমে থাকে। এটি অকপটে আমরা স্বীকার করি। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারব বলে মনে করি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট রয়েছে এটা সত্যি। আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এখন সব একসাথে সমাধান করতে পারবো না। সামনে বঙ্গবন্ধু হলের এক্সটেনশন করা হবে সেখানে অনেক শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। এছাড়াও অনেক মেয়াদ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী হলে থাকে। আমরা হল প্রশাসনকে বলেছি, অছাত্রদের হল থেকে বের করতে। যারা বৈধ শিক্ষার্থী তাদের সিটের ব্যবস্থা করতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ১২৮টি গণরুমের কথা জানালে তিনি বলেন, আপনারা তালিকা দেন। আমি ব্যবস্থা নেব।