জাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৫ বাস আটক
‘গাড়ির চাকা ঘুরলে দুইটা টাকা পাই। গাড়ির চাকা বন্ধ তো টাকাও বন্ধ। আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে, কাজ করলে ভাত জোটে, না হলে অনাহারে থাকা লাগে। গাড়ির চাকা না চললে আমাদের পেটেও ভাত জোটে না। গ্রামে ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ মা-বাবা আছে। নিজে দুইটা খাওয়ার পরে তাদের টাকা পাঠাতে হয়’-কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচল করা সেলফী পরিবহনের বাসের হেলপার মো. রেজাউল।
এই পরিবহনের একটি বাসের বেপরোয়া গতির চাপায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক শিক্ষার্থী রুবেল পারভেজের মৃত্যুতে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের দাবিতে ওই পরিবহনের ১৫টি বাস আটক করে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত বাসগুলো ছাড়া হবে না বলে জানিয়েছে তারা। তবে বাস মালিক পক্ষ এ দাবি পূরণে অস্বীকৃত জানাতে বাস আটকের ৪৮ ঘণ্টা পরেও সুরাহা হয়নি বিষয়টির। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক বাসশ্রমিক।
আজ শনিবার বেলা ১২টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সারি বেঁধে ১৫টি বাস আটক করে রাখা হয়েছে। বাসগুলোর কর্মচারীরা পাহারা দিচ্ছেন তাদের মালিকের বাস। কেউবা অনাহারে আছেন শুয়ে বসে।
নিহত রুবেল পারভেজ এবার ৪১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন রুবেল পারভেজ। এ সময় সেলফী পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষিতে একটি বাস যাত্রীদের চাপা দেয়। এতে রুবেলসহ দুজন নিহত হন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই দিনই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী সেলফী পরিবহনের ২০টি বাস আটক করেন। গতকাল শুক্রবার সকালে আরও ৫টিসহ মোট ২৫টি বাস আটক করা হয়। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ১০টি বাস ছেড়ে দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেলফী পরিবহনের বেপরোয়া গতি এবং চালকের সহকারীদের খারাপ আচরণ, হাফ ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ইত্যাদি কারণে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল তাদের। বাসের চাপায় রুবেল পারভেজের নিহতের পর এ ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা সেলফী পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।
সেলফী পরিবহনের মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,তারা বিভিন্ন সময় বাসের চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেন। তারপরও তারা বিভিন্ন সময় অশোভন আচরণ করেন। দুর্ঘটনায় জড়িত বাসের চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ফটোকপি করে থানায় জমা দেওয়া হয়েছে। একটি বাসের অপরাধে এতগুলো বাস আটকে থাকার কারণে তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন, তা দিতে মালিকপক্ষ অপরাগতা প্রকাশ করেছে।
আটক করা বাসের একাংশের মালিক শফিউদ্দীন বলেন, আমাদের বেশির ভাগ মালিকের বাস কিস্তি দিয়ে কেনা। আমার নিজের ২টি কিস্তি দিয়ে কেনা। প্রতিমাসে ৭০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। এতগুলো বাস আটকানোয় আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় পড়েছি। শিক্ষার্থীরা ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাচ্ছে। আমরা তিন লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছি, কিন্তু তারা সেটা মানছে না। আমরা চাই দ্রুত এর সুরাহা হোক।
নিহত রুবেল পারভেজের ছোট ভাই সোহেল পারভেজ বলেন, ভাই আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার ১৬ মাসের বাচ্চা রয়েছে, স্ত্রী রয়েছে। তাকে হারিয়ে আমরা আমাদের একমাত্র অবলম্বনকে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সেলফি পরিবহণ নামক এই মৃত্যুফাঁদ থেকে রক্ষা চাই। আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। ভাইয়ের শিশু বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা এর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, বাস আটকে রাখার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির জন্যও খুব একটা সুবিধাজনক নয়। আমরা পরিবার পক্ষ ও মালিকপক্ষ উভয়কে আজকে ডেকেছি। তারা আসলে বিষয়টি নিয়ে আমরা বসবো এবং অতি দ্রুত দুই পক্ষের দাবি অনুযায়ী বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো।