বাসের চাকায় পিষ্ট জীবনযুদ্ধে হার না মানা রুবেলের স্বপ্ন
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন জীবনযুদ্ধে হার না মানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী রুবেল পারভেজ। পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনের উপার্জনে চলত পরিবারের খরচ আর তিন ভাই-বোনের লেখাপড়া। সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ৪১তম বিসিএসে। কিন্তু রুবেলে এত সংগ্রাম আর জীবনযুদ্ধের পথ শেষ হয়ে গেছে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের বন্দে কাওয়ালজানী গ্রামে বাড়ি রুবেল পারভেজের (৩০)। বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকার ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডে সেলফি পরিবহন নামের বাসের চাপায় প্রাণ হারান তিনি। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে আরও একজনের। দেড় বছরের শিশু রাইসা হারাল তার বাবাকে। স্ত্রী, মা আর ভাই-বোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন শুধুই চোখের পানি ফেলছেন।
মেয়ের সঙ্গে রুবেল পারভেজ
৩২ বছর বয়সী রুবেল পারভেজ ধামরাই পৌরসভার পাঠানতোলা এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। মানিকগঞ্জে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার মোকছেদ আলীর ছেলে রুবেল সম্প্রতি ৪১তম বিসিএস এ সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ধামরাই পৌর এলাকার বাগনগর এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে কর্মস্থলে যেতে বাসের জন্য অপেক্ষার সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা।
আরও পড়ুন: যবিপ্রবিতে ১৭ চাকরিপ্রার্থীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখল ছাত্রলীগ
রুবেলের ছোট ভাই সোহেল পারভেজ বলেন, ‘ছোটবেলায় আমাদের বাবা মারা যান। তখন থেকেই ভাইয়া সংগ্রাম করে লেখাপড়া করছে। আমাদের তিন ভাই ও এক বোনের পড়া এবং সংসারের খরচ টিউশনি করে ভাই চালাত। এত কষ্টের মধ্যেও ভাইয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। দুই বছর হলো বিয়ে করছে ভাইয়া। ১৮ মাসের একটা মেয়েও আছে তার। আমার ভাইকে সড়কে হত্যা করা হয়েছে। এটা কোনো দুর্ঘটনা হতে পারে না। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।’
ঘটনার দিন বেলা আড়াইটার দিকে রুবেল পারভেজের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হলে তাঁর বৃদ্ধ মা কুলসুম বেগম বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, ‘স্বামী হারাইছি। কত কষ্ট করছি। সন্তানগো বুঝবার দেই নাই। আমি অহন কি করুম?’ রুবেলের স্ত্রী ফারজানা আফরিন বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। এক বছরের মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন, তা বলে বিলাপ করতে থাকেন।
ছেলেকে হারিয়ে কুলসুম বেগমের আহাজারি
এদিকে রুবেল পারভেজের মৃত্যুর সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোক নেমে এসেছে তার সহপাঠী, বন্ধু ও প্রিয়জনদের মাঝে। রুবেলের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও সেলফি পরিবহনের রুট পারমিট বাতিলসহ বয়কটের ডাক দিয়েছেন তারা।
রুবেলের বন্ধু ননী গোপাল বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর থেকেই রুবেল ওর পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে। টিউশনি করে খরচ চালিয়েছে, নিজে পড়াশুনা করেছে। সবশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। ধামরাইয়ে ২০০৭ সাল থেকেই ভাড়া বাসায় বসবাস করত রুবেল। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। ওর দেড় বছরের রাইসা নামে একটা মেয়ে আছে। ওর স্ত্রী ফারজানা অনার্সে অধ্যয়নরত। কোনোভাবেই ওর মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।’