বিভাগে ‘নারী শিক্ষক নিয়োগ’ হয় না শুনে স্বপ্ন ভেঙে যায়
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর স্বপ্ন ছিল নিজ বিভাগের শিক্ষক হওয়ার, কিন্তু যখন দেখি একজনও নারী শিক্ষক নেই বিভাগে। যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না, তখন স্বপ্নটা ভেঙে যায়’— বিশ্ববিদ্যালয়টির আরবী বিভাগে স্নাতক পড়ুয়া এক নারী শিক্ষার্থী এভাবেই তার স্বপ্নভঙ্গের কথা জানান।
১২টি বিভাগ নিয়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। তার মধ্যে একটি আরবী বিভাগ। শতবর্ষের বেশি বয়সী এই বিভাগে এ পর্যন্ত নারী শিক্ষক ছিল মাত্র দু’জন। বর্তমানে শতভাগ পুরুষ শিক্ষক দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির একমাত্র বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরবী বিভাগে ছাত্রী কম থাকা, শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী না থাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ‘রাজনৈতিক লবিংয়ে’ বিভাগের মেয়েরা শিক্ষক হওয়ায় পিছিয়ে রয়েছেন। তাছাড়াও বিভাগটিতে নারী শিক্ষক না নেওয়ার একটা কালচার তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তবে বিভাগটির বর্তমান শিক্ষকরা বলছেন, মেয়েদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী না থাকায় নেই কোনো নারী শিক্ষক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে বিভাগটিতে নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।
জানা গেছে, বিভাগটিতে ড. ফাতেমা সাদেক, ১৯৫০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রথম নারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অন্যজন অধ্যাপক সায়েরা খাতুন, ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে শিক্ষকতা শুরু করে ২০০৮ সালে অবসরে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য, ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, প্রক্টরিয়াল বডিসহ বিভিন্ন পদে নারীরা দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষী আরবী বিভাগে নারী শিক্ষক ছিলেন মাত্র দু’জন। বিভাগটির ছাত্রীদের অভিযোগ, কোনো নারী শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ায় ছাত্রীরা ভালো একাডেমিক রেজাল্টে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আরবী বিভাগে ২৪ জন শিক্ষকের মধ্যে একজনও নারী শিক্ষক নেই। সর্বশেষ দেড় দশক ধরে বিভাগটিতে নেই নারী শিক্ষক। তবে বর্তমানে বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শতাধিক নারী শিক্ষার্থী রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের নারী শিক্ষক না থাকার কারণে আমরা অনেক কিছু শেয়ার করতে পারি না। ক্লাসরুমে এমনও হয়েছে যে মেয়েদের যে শারীরিক সমস্যা হয় সেসময় পুরুষ শিক্ষক ক্লাস করাচ্ছেন। স্যারদেরকে বলে বের হওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সমস্যার মধ্যে এরকম সমস্যাগুলোও আমরা ফেস করি।
তিনি আরও বলেন, এমনকি আরও অনেক ক্ষেত্রে কোনো খোলামেলা কথা শেয়ার করতে পারি না। অনেকসময় শিক্ষকের কাছে ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো পরামর্শ নেব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না। নারীর জীবনের অনেক কিছু থাকে যা একজন নারী শিক্ষক ভালো বুঝতে পারবেন। তাছাড়া সব বিভাগে নারী শিক্ষক আছে, শুধু আমাদের বিভাগে নেই। এটা নিয়ে স্যারদের বলা হয়েছিল যে আমাদের বিভাগে নারী শিক্ষক নেই কেনো? উনারা বলেছেন, ওরকম কেউ যোগ্য হতে পারেনি।
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই কাজ করে। আমার ইচ্ছে ছিল ভর্তি হওয়ার পর যে ইউনিভার্সিটির টিচার হবো। তো যখন দেখলাম আমাদের বিভাগে কেউ টিচার হয়নি। তখন এ স্বপ্নটা মন থেকে উঠে যায়। আশাহত হয়ে যাই। যেহেতু টিচার হয় না সেহেতু রেজাল্ট করে টিচার হতে পারব না। এজন্য ওদিক থেকে আশাহত এবং কিছুটা ডিপ্রেসড; যে টপ থাকলেও ডিপার্টমেন্ট জায়গা হয় না। অনেক সময় শিক্ষকদের বললে তারা বলে তোমরা যোগ্য হয়ে আসো। আল্টিমেটলি দেখা যাচ্ছে যোগ্য হয়ে গেলেও নেওয়া হয় না। পূর্বে আমাদের বিভাগে নারী শিক্ষার্থী কম ছিল এটা ঠিক। তবে এখনো অনেক নারী শিক্ষার্থী আছে।
আরবী বিভাগের আরেকজন নারী শিক্ষার্থী বলেন, নারী শিক্ষক থাকলে ভালো হতো। সব বিভাগেই আছে। শুধু আমাদের নেই। সবাই মেইল টিচারের কাছেই যায়। সবাইতো পার্সোনাল সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যায় না। তবে একাডেমিক ক্ষেত্রে যারা যায় সবাই হেল্প পায়।
জানতে চাইলে আরবী বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক যুবাইর মোহাম্মদ এহসানুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নিশ্চয়ই যদি নারী শিক্ষক থাকতো তাহলে মেয়ে শিক্ষার্থীরা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। তাদের অনেক বিষয় পুরুষ টিচারদের বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। আমাদের বিভাগের মেয়েরা আরো কনজারভেটিভ হয়। তারা তো আরও বেশি সংকোচ বোধ করবে।
তিনি বলেন, নারী শিক্ষক কম হওয়ার কারণ আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থী কম ছিল। এটা একটা ব্যাপার। ১৯৯৩ সালে আমাদের সময় শুধু একজন মেয়ে ছিল। এরপর ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে কোনো মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল না। তবে ২০০০ সালের পর নারী শিক্ষার্থী বেড়েছে আর সর্বশেষ ২০১০ সালের পর সেটি আরও বেড়েছে। অনেক সময় মেয়েদের মধ্যেও ভালো রেজাল্ট ছিল না।
ভালো রেজাল্ট ছিল কিন্তু তাদেরকে নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সামনে যদি নিয়োগ হয় এবং যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই আসবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই।
শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধিতা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে টিচারদের চাওয়া না চাওয়ার কোনো বিষয় না। এটা নিয়োগ দেয় বোর্ড। বোর্ডে একজন বা দুজন ডিপার্টমেন্ট থেকে থাকে। আগে যোগ্য ক্যান্ডিডেট পাওয়া যায়নি। কারণ তখন মেয়ে শিক্ষার্থী কম ছিল। এখন নারী শিক্ষার্থী বাড়ছে। যোগ্য ক্যান্ডিডেট স্বাভাবিকভাবে আসবে। নারী হলে বিভাগে নিয়োগ হবে না এমন কোনো পলিসি নেই। নিয়োগ তো বিভাগ দেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় বডি আছে। তারা দেয়।
বিভাগে নারী শিক্ষার্থী কম আসার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরবী বিভাগে ভর্তির শর্ত হলো কমপক্ষে দাখিল পাশ করতে হয়। কারণ আরবীর একটা ব্যাকগ্রাউন্ড লাগে। আগে মাদ্রাসার মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম আসত। এজন্য নারী শিক্ষার্থী কম ছিল। তবে এখন নারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি আসছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরবী বিভাগের একজন শিক্ষক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখন বিভাগে শতাধিক ছাত্রী আছে। তাদের অনেক বিষয় পুরুষ শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করতে পারে না। তবে প্রশাসন চাইলে বিভাগে নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব।