২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:০৬

ছাত্রলীগ নেতাকে পেটানোর পর শরীরে মদ ঢেলে উল্লাস সহযোগীদের

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের আপন ছোট ভাই আরমান খান যুবর বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মওলানা ভাসানী হলে ‘টর্চার সেল’ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এতে মারধরের শিকার হন শাখা ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাহিদ হাসান ইমন।

বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যুবসহ আরও তিন জনের বিরুদ্ধে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষের ওই টর্চার সেলের বর্ণনা দেন ভুক্তভোগী এই ছাত্রলীগ নেতা।

আরমান খান যুবর ছাত্রত্ব শেষ হলেও প্রভাব খাটিয়ে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষের ওই ‘টর্চার সেলে’ নিয়ন্ত্রণ করতে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এমনকি সেখানে বহিরাগতদের নিয়ে নিয়মিত মাদক সেবন করেন।

ভুক্তভোগী জাহিদ হাসান ইমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের (৪৬তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলের আবাসিক ছাত্র। 

অন্যদিকে অভিযুক্তরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (৪১তম ব্যাচ) সাবেক শিক্ষার্থী আরমান খান যুব, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের (৪২তম ব্যাচ) আরাফাত, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৫তম ব্যাচ) তুষণ ও অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তি। এদের মধ্যে আরমান খান যুবসহ প্রায় সকলেরই কয়েকবছর আগেই ছাত্রত্ব শেষ হলেও তারা মওলানা ভাসানী হলের কয়েকটি কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে অবস্থান করছেন।

ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, তুচ্ছ ঘটনায় গত ১৩ আগস্ট সাভারের রেডিও কলোনির বউবাজার এলাকার ভাড়া বাসার মালিকের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় ইমনের। ওই ঘটনার জেরে ইমনকে ফোন করে আরমান খান যুবর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন বাড়ির মালিকের পূর্ব পরিচিত আরাফাত। তার পরিপ্রেক্ষিতে যুবর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে, ইমনকে মওলানা ভাসানী হলের সামনে যেতে বলেন (আরাফাত) তিনি।

রাত ১২টার দিকে ইমন সেখানে গেলে যুব মোটরসাইকেল হলের ভেতরে রেখে তাকে (ইমন) ১২৬ নম্বর কক্ষে যেতে বলেন। এরপর কক্ষে ঢুকতেই চড়-ঘুষি মেরে ইমনের নাক ফাটিয়ে দেন যুব। তখন যাতে চিৎকার করতে না পারেন, তাই ইমনের মুখ বেঁধে দেন আরাফাত।

পরে যুব ও আরাফাতসহ সেখানে উপস্থিত অন্য অভিযুক্তরা ইমনকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। এ সময় ইমন তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেও কোনো প্রতিকার পাননি। তাকে একদফা মারধরের পর ইয়াবা সেবন করেন যুব। পরে আবারও ইমনের উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন তারা। সঙ্গে ইমনের শরীরে মদ ঢেলে উল্লাস করতে থাকেন যুব ও তার সহযোগীরা।

এরপর রাত তিনটার দিকে ইমনকে হলের দ্বিতীয় তলার ২২৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তাকে পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়ে আসতে বলেন তুষণ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলকে গালাগালি করেছেন বলে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেন। এমনকি সেটা মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেও রাখেন তুষণ।

এরপর তাকে ফের ১২৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় ইমনকে। এসময় মারধরের ঘটনা কাউকে না জানাতে ইমনের পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেন এ ঘটনায় জড়িতরা। কিছুক্ষণ পর আকতারুজ্জামান সোহেল ওই কক্ষে গিয়ে ইমনকে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও ইমনকে আশ্বাস দেন।

এদিকে, ঘটনার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসানকে অবহিত করেন ইমন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মারধরের ঘটনার বিষয়ে জানাতে ১৪ আগস্ট সকালে প্রক্টরের বাসায় যান তিনি। তবে ইমন সেখানে গিয়ে দেখেন আকতারুজ্জামান সোহেল আগে থেকেই প্রক্টরের বাসায় অবস্থান করছেন।

হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকেন, সে বিষয়টি আমি জানি। আমি এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে মারধরের ঘটনা আমি জানি না। -অধ্যাপক সায়েম, প্রাধ্যক্ষ, মওলানা ভাসানী হল

এসময় ইমনকে মওলানা ভাসানী হলের অতিথি কক্ষে (গেস্টরুম) গিয়ে বসতে বলেন (প্রক্টর) তিনি। তখন ইমন প্রক্টরের উপর ভরসা না পেয়ে তার বাসা থেকে চলে যান। এরপর তিনি মারধরের বিষয়টি আল নাহিয়ান খান জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের জানান।

জানা যায়, আরমান খান যুবর ছাত্রত্ব শেষ হলেও প্রভাব খাটিয়ে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষের ওই ‘টর্চার সেলে’ নিয়ন্ত্রণ করতে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এমনকি সেখানে বহিরাগতদের নিয়ে নিয়মিত মাদক সেবন করেন তিনি। এর আগেও মাদক ব্যবসায়ী ও বহিরাগতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে টর্চার করেন যুব। 

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারীদের নিয়ে তিনি চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্ম করে আসছেন বলেও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ অস্বীকার করে মারধরের ঘটনায় জড়িত আরাফাত বলেন, ‘তূষণকে সাভারের এক বাড়িওয়ালা জানান যে ইমন নামের ছাত্রলীগের এক ছেলে ‘ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে’ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই হিসেবে ইমনকে ১২৬ নম্বর রুমে ডেকে পাঠাই। ওই রুমে আমি, তূষণ ও যুব থাকি। সেখানে ইমনকে আমরা ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, সে ভুল করেছে। সে সেটা স্বীকার করলে আমরা তাকে ছেড়ে দেই। তাকে কোন ধরনের মারধর করা হয়নি।’

জানতে চাইলে ভুক্তভোগী জাহিদ হাসান ইমন বলেন, ‘মারধর পরবর্তী নানা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের উপর আমার ভরসা উঠে যায়। পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেইনি। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের জানিয়েছি। তবুও বিচার না পেয়ে কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি। কারণ ওই রাতের ঘটনায় আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরমান খান যুব ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

একদফা মারধরের পর ইয়াবা সেবন করেন যুব। পরে আবারও ইমনের উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন তারা। সঙ্গে ইমনের শরীরে মদ ঢেলে উল্লাস করতে থাকেন তার সহযোগীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘যুবর রুমে নির্যাতনের এই ঘটনাটি প্রথমে আমি জানতাম না। তবে পরে মারধরের বিষয়টি ইমন আমাকে মেসেঞ্জারে জানিয়েছিল। আমি তখন তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। কিন্তু সে লিখিত অভিযোগ না দিয়ে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে চায়। সেক্ষেত্রে কেউ বিচার না দিলে আমি তার বিচার কীভাবো করবো?’

জানতে চাইলে মওলানা ভাসানী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুসাইন মো. সায়েম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকেন, সে বিষয়টি আমি জানি। আমি এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে মারধরের ঘটনা আমি জানি না।’