১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:৪৭

অভিযুক্তরাই শীর্ষ দুই পদে এগিয়ে

অভিযুক্ত ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা।  © সংগৃহীত

আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের ২৬তম সম্মেলন। এবার শীর্ষ দুই পদে ৯৪ জন পদপ্রত্যাশীরা জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। নতুন কমিটিতে পদ পেতে শেষ সময়ে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু শীর্ষ দুই পদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা বেশিরভাগই অছাত্র, বিবাহিত, ড্রপআউট, বিভিন্ন অপকর্মে ‘বিতর্কিত’ ও সম্মেলনকে ঘিরে হঠাৎ সক্রিয় নেতারা। 

সভাপতি-সম্পাদক পদ বাগিয়ে নিতে ক্যাম্পাসে মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি নিয়মিত স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের দুয়ারে ধরণাও দিচ্ছেন তারা। 

অভিযোগ আছে, শীর্ষ দুই পদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা বেশিরভাগই অছাত্র, বিবাহিত, ড্রপআউট, বিভিন্ন অপকর্মে ‘বিতর্কিত’ ও সম্মেলনকে ঘিরে হঠাৎ সক্রিয় নেতারা। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স ও ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজ’র ৬ মাসব্যাপী সংক্ষিপ্ত কোর্সের ভর্তি হয়ে রয়েছেন। 

কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫ ধারার ‘গ’ উপধারা অনুযায়ী ‘যেকোনো নিয়মিত ছাত্র ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য হতে পারে।’ তবে নিয়মিত ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে মরিয়া কয়েকজন নেতা। যা সরাসরি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রেরই পরিপন্থী। 

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক (লিংকন) ও মেজবাহুল ইসলাম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন ও ফয়েজ আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক তাওহীদ দূর্জয়, কার্যনির্বাহী সদস্য আল মুক্তাদির তরঙ্গ, কর্মী অনিক মাহমুদ বনি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সাকিবুল হাসান বাকি এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ, বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাবিরুজ্জামান রুহুল ও হবিবুর রহমান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান অপুসহ অনেকে। নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকা এসব নেতাদের অধিকাংশের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আবার অনেকে হয়েছেন ড্রপআউট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসন্ন সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব তার জীবনবৃত্তান্তে
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতক পরীক্ষার প্রথম বর্ষের একটি প্রবেশপত্রের কপি সংযুক্ত করেছেন। তবে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষার প্রবেশপত্রের কোনো কপি সংযুক্ত করেননি। 

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে বারবার ড্রপআউট হওয়ায় ভর্তি বাতিল হয়ে যায়।
এছাড়াও স্নাতকের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য প্রদান করেননি। জীবনবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন, তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. মোশতাক আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্র সংযুক্ত করেছেন। প্রত্যয়নপত্র অনুযায়ী, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী না, বরং সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
    
 এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেজ-এর পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন পত্রে ৬ মাস মেয়াদী একটি কোর্সে ভর্তির তথ্য প্রদান করেছেন। যার শিক্ষাবর্ষ ছিল ২০২১-২২ এবং মেয়াদকাল ছিল সেই শিক্ষাবর্ষের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন কি না এ প্রসঙ্গে জানতে আসাদুল্লাহ-হিল-গালিবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
 
ড্রপআউটপের বিষয়টি এড়িয়ে এ বিষয়ে গালিব বলেন, আমি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। আপনারা বেশি কিছু জানতে চাইলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কোনো অধ্যাপককে ফোন দেন। তাহলেই সব জানতে পারবেন।

মাদকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদপ্রার্থীদেরকে ডোপ টেস্ট করানো হোক। তাহলেই বুঝা যাবে।

আরেক পদপ্রার্থী মেহেদী হাসান মিশুর জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, তার সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্নাতক চলমান’। তিনি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থীকে ৬ বছরের মধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু মিশু ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হয়েও তার জীবনবৃত্তান্ত উল্লেখ করেছেন, তার স্নাতক এখনও চলমান। হিসাব অনুযায়ী, তার স্নাতক শুরুর ইতোমধ্যে ৮ বছর পেরিয়ে গেছে।

এছাড়াও এই নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলে এক শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে।

তার ছাত্রত্বের বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, এটা অনেক আগের কাহিনী। এখন তার ছাত্রত্ব আছে বলে মনে হয় না। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করে, তাদের কিছু অপকর্মের অভিযোগ আমার দিকে এসেছে। তবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ঘটনায় জড়িত নই।’

আসন্ন সম্মেলনে পদপ্রার্থী গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তবে এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাংগুয়েজেজ এ ভর্তি আছেন। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন যাবত ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার পর সম্মেলনকে ঘিরে হঠাৎ সক্রিয় হওয়ারও এবং বিতর্কিতদের নিয়ে নিয়মিত মিটিং মিছিল ও শোডাউন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাংগুয়েজেজ এ ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় ভর্তি আছি। আমি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলাম না। করোনাকালীন সময়ে আমি নিষ্ক্রিয় ছিলাম। কারো কাছে যদি মনে হয় যে, করোনাকালীন সময়েও রাজনীতি করতে হবে, তাহলে আমার কিছু বলার নাই।

কর্মীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সাথে অনেক কর্মী আছে। এখন তাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের দায়ভার তো আমি নিতে পারি না।

সভাপতি পদপ্রার্থী কাজী আমিনুল ইসলাম লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে স্নাতক শেষ করেছেন এবং ২০২১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্রত্ব না থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রার্থী ৫ বছর আগে বিয়ে করেছেন বলে জানা গেছে। আয়ান নামে একটি ছেলে সন্তানও আছে।

কুষ্টিয়া সদরের হাউজিং 'সি' ব্লকের বাসিন্দা তেল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন খোকনের মেয়ে রিফা তিন্নীকে ২০১৭ সালের ২৭ জুন বিয়ে করেন তিনি। কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আতিকুর রহমান অনিকের আপন খালাতো বোন তিনি। 

বিয়ে কিংবা তার ছেলে সন্তান নেই দাবি করে লিংকন বলেন, ‘বিরোধীপক্ষ এসব ছড়াচ্ছে। আমি কখনো বিয়ে করিনি। তবে এক মেয়ের সঙ্গে ২০১৩ সালে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।’
ছাত্রত্ব না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বর্তমানে মার্কেটিং বিভাগের একটি সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি আছি।

একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক এবং ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনিও ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজর জার্মান ভাষার সংক্ষিপ্ত কোর্সে ভর্তি রয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমি এখনো সংগঠনে থাকার যোগ্য। এ বিষয়ে অনেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে।

আরেক পদপ্রার্থী মেজবাহুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তার পরিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে ক্যাস্পাসে প্রচার আছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে মেসবাহুল ইসলাম বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজ এর ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি আছি। আমার ৮ বছরের রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনাদর্শিক ও অসাংগঠনিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ কেউ দিতে পারলে আমি ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেটশিপ ও সহ-সভাপতি পদ থেকে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব।

এছাড়াও আলোচনায় থাকা সাকিবুল হাসান বাকি বিগত সাত বছর ক্যাম্পাসে রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পৃক্ত না থাকার অভিযোগ আছে। কিন্তু সম্মেলনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে এর আগে, একই প্রসঙ্গে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, আমি গত কমিটিতে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলাম। কিন্তু সেটি হতে পারিনি। যার কারণে আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছে তাদেরকে পদ-পদবী দেয়া হয়নি। তাই এখন যারা পদে আছে তারা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের কারণে বলছে আমরা ছাত্রলীগ থেকে নিষ্ক্রিয়।

আলোচনায় থাকা আরেক নেতা অনিক মাহমুদ বিরুদ্ধে রয়েছে ছিনতাইয়ের অভিযোগ এবং এই অভিযোগে তিনি একমাস জেল হাজতেও ছিলেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউটও বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বনি বলেন, এই অভিযোগ এবং মামলা পুরোপুরি প্রতিহিংসা এবং ষড়যন্ত্রমূলক। সেই মামলাটি ইতোমধ্যে নিষ্পত্তিও হয়েছে। আর বিভাগে আমার ইয়ার গ্যাপ আছে। তবে আমি এখনও নিয়মিত শিক্ষার্থী।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব একটি বিতর্কবিহীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি উপহার দিতে। এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই সচেষ্ট এবং আমরা সর্বোচ্চভাবে ইচ্ছুক যেকোনো প্রকার বিতর্ক আমাদের এই কমিটি নিয়ে যেন না হয়।’