০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০০

শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল করে দ্বিতীয় শ্রেণি, বিরোধিতা সিন্ডিকেট সদস্যদের

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আবেদনের জন্য অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় অন্তত প্রথম শ্রেণি (৬০ শতাংশ মার্কস) থাকার নিয়ম রয়েছে। অথচ সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সাইন্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে এ নিয়ম শিথিল করে দ্বিতীয় শ্রেণি (সেকেন্ড ক্লাস) করা হয়েছে। যোগ্যতা এভাবে শিথিল করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মত অনেকের। সিন্ডিকেটেরে একাধিক শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য এর তীব্র বিরোধিতাও করছেন।

জানা গেছে, প্রভাষক পদে তিনজন শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে উল্লেখ করা হয়, গ্রেডিং পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এসএসসি এবং এইচএসসি (সমমান) পরীক্ষায় আলাদাভাবে নূন্যতম জিপিএ ৩.০০ অথবা উক্ত দুটি পরীক্ষায় মোট নূন্যতম ৭.০০ থাকতে হবে।

অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিতে পুরোনো গ্রেডিং পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সিজিপিএ একটিতে ৩.৫০ ও অন্যটিতে ৩.৩০ থাকতে হবে। অথবা বর্তমান পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের একটিতে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০ এবং অন্যটিতে ৩.৪০ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে বলছে, নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না।

শিক্ষক নিয়োগ শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. হাছান মিয়া বলেন, ২০১৮ সালে যখন স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, তখন চার-পাঁচ জন প্রার্থী আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশ হতে হতে আমাদের আবেদনের সময় শেষ হয়ে যায়। ফলে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর আর কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। 

এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে বেরিয়েছেন। পুনরায় বিজ্ঞাপন দিলে যোগ্য শিক্ষক পাবো বলে আমার বিশ্বাস।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করার চতুর্থ বর্ষে চলতি বছরের ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪৩তম সিন্ডিকেট এক সদস্যের একটি কমিটি অনুমোদন করে। এতে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুককে নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৫৪৪তম সিন্ডিকেটে তিনি যোগ্যতা শিথিল করে নীতিমালা পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করেন।

এতে দেখা যায়, বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের আত্মীকরণের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগসহ প্রভাষক পদে নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। এছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি সিজিপিএ অথবা গ্রেড, যা ২০১৮ সালের বিজ্ঞাপ্তিতে সুস্পষ্ট ছিল। এ নিয়ে একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য বিরোধিতা করেছেন এবং শিক্ষক মহলে শুরু হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের আত্মীকরণের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগসহ প্রভাষক পদে নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। এছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি সিজিপিএ অথবা গ্রেড, যা ২০১৮ সালের বিজ্ঞাপ্তিতে সুস্পষ্ট ছিল। এ নিয়ে একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য বিরোধিতা করেছেন এবং শিক্ষক মহলে শুরু হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

সুপারিশে বলা হয়েছে, পুরোনো ডিভিশন পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিতে কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগ থাকতে হবে। তাছাড়া স্বীকৃত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় হতে থাকতে হবে প্রথম বিভাগসহ বিপিএড এবং এমপিএড ডিগ্রি।

এতে আরও বলা হয়েছে, চবি শারীরিক শিক্ষা বিভাগে বর্তমানে কর্মরত উপরোক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা যাদের ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের বিভিন্ন তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক কোর্সে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদেরকে বর্তমান পদমর্যাদা ও অন্যান্য যোগ্যতাকে যথাযোগ্য পদে রূপান্তরপূর্বক নিয়োগ বা আত্মীকরণ করা যেতে পারে।

এক্ষেত্রে তাঁদের বর্তমান বেতন স্কেল (গ্রেড) ও মূল বেতন ব্যক্তিগত ক্ষেল ও বেতন হিসেবে বহাল রাখা যেতে পারে। এছাড়াও অনির্দিষ্টভাবে জীবনের দুটি স্তরে প্রথম শ্রেণি থাকলে প্রভাষক পদে আবেদনে যোগ্য হবে বলা হয়েছে।

সুপারিশে বলা হয়, বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক কোর্সে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে একাধিকক্রমে কমপক্ষে ৫ (পাঁচ বছর) পাঠদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি (এমফিল/পিইচডি) রয়েছে, কিন্তু শিক্ষাজীবনের যে কোন স্তরে দু'টি প্রথম শ্রেণি/বিভাগ রয়েছে, তারা প্রভাষক পদে আবেদনের জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।

আরো পড়ুন:  চার বিষয়ে অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রক্রিয়াধীন ২৭টি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি এক সদস্যবিশিষ্ট হওয়া অযৌক্তিক। সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ৫৪৪তম সিন্ডিকেটে প্রথম অংশগ্রহণ করেছি। এর আগে সিন্ডিকেটে কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন না। সে সময় এক সদস্যের এ কমিটিকে অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট। একজনের কমিটির এ নীতিমালা খুবই অদ্ভুত।

আমরা শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ৫৪৪তম সিন্ডিকেটে প্রথম অংশগ্রহণ করেছি। এর আগে সিন্ডিকেটে কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন না। সে সময় এক সদস্যের এ কমিটিকে অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট। একজনের কমিটির এ নীতিমালা খুবই অদ্ভুত: সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী

আরেক সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, এক্ষেত্রে একাধিক শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী যোগ্য শিক্ষক পেতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে যোগ্যতা শিথিল করা ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল হতে পারে বলে মত এসেছে। সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, বর্তমানে একাডেমিক ফলাফলকে সিজিপিএ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সুপারিশ করা নীতিমালায় পুরোনো পদ্ধতির দ্বিতীয় বিভাগকে (সেকেন্ড ডিভিশন) শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা রাখা হয়েছে। বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল। প্রশাসন এক সদস্যের কমিটি করে বিভাগটিতে আত্মীকরণের নামে আত্মীয়করন করার চেষ্টা করছে।

পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া নিয়ে আরেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান বলেন, আমরা ৫৪৪তম সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে বারবারই বলেছি, পুনরায় বিজ্ঞাপনের বিষয়ে। আমরা চাই যোগ্য এবং মেধাবীরা শিক্ষক হোক। 

সূত্রে জানা গেছে, যোগ্যতা শিথিলের এ সুপারিশ ৫৪৪তম সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। কার্যবিবরণীতে যোগ্যতা শিথিলের এ সুপারিশকে সিদ্ধান্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সিন্ডিকেট সভার ১৫ দিনের মধ্যে কার্যবিবরণী দেওয়ার কথা থাকলেও প্রশাসন তা দিতে প্রায় দেড় মাস সময় নেয়।

সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বিকৃত করার অভিযোগে দু'জন সিন্ডিকেট সদস্য উপাচার্যকে চিঠিও দিয়েছেন। তারা বলছেন, সিন্ডিকেটে নেওয়া হয়নি এমন সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবায়নের জন্য।

বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল। প্রশাসন এক সদস্যের কমিটি করে বিভাগটিতে আত্মীকরণের নামে আত্মীয়করন করার চেষ্টা করছে: সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী

এ বিষয়ে ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সাইন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেন, ‘ফিজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ডেপুটি ডিরেক্টররা শুরু থেকেই এ বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস নিচ্ছেন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তাই খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে তারা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তাঁদের থেকে আত্মীয়করণ করার বিষয়ে সুপারিশ এসেছে।

তিনি বলেন, যাকে ভালো মনে করেন, উপাচার্য তাকে শিক্ষক হিসেবে আত্মীয়করণ করে নিবেন। আমাদের শিক্ষক খুবই প্রয়োজন। সেজন্য কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ একজনকে আত্তীকরণ করার কথা বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদ বলেন, পুরোনো বিজ্ঞপ্তির যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষক না পাওয়ায় নতুন করে যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। তাছাড়া, শারিরীক শিক্ষা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে পার্টটাইম ক্লাস নেয়। তাদের মধ্যে একজনকে শিক্ষক হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আত্মীকরণের মাধ্যমে।

যোগ্য শিক্ষকের খোঁজে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রেজিস্ট্রার কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।