১৩ আগস্ট ২০২৩, ১০:০১

ঢাবি ক্যাম্পাসে বাড়ছে অপ্রীতিকর ঘটনা, কার্যকর পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অমর একুশে হলের শিক্ষকদের আবাসিক ভবন গেট সংলগ্ন রাস্তার ময়লার স্তুপ থেকে গত শুক্রবার রাতে দু’টি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ক্যাম্পাসের ভেতরে দু’টি নবজাতক কে বা কারা হত্যা করে ফেলে যায়, সেটিও এখনো অজানা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও অর্থবহ কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায়ই ঘটছে এমন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা, যা ক্যাম্পাসে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি কার্জন এলাকায় তরুণ-তরুণীর আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হলে সেটিও আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দুতে পরিণত হয়। ক্যাম্পাসের বটতলা, আমতলা, মুহসীন হল মাঠ, মল চত্বর ও শ্যাডোর মাঝের স্থান, কার্জন হলের পেছনের এলাকা, শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়সহ অনেক জায়গায় লাইটিং ব্যবস্থা কম থাকায় নিয়মিতই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ের ঘনিষ্ঠতাও যেন বেড়ে যাচ্ছে এ সুযোগে। আমতলা ও গুরুদুয়ারা নানকশাহীর দেয়াল বরাবর এবং কার্জন হলের পেছনের বারান্দায় রেলিংয়ের আড়ালে বসে থাকতে দেখা যায় কাপলদের। এ সময় অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। 

সম্প্রতি কার্জন হল এলাকায় সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. হাসান ফারুকের নেতৃত্বে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করেছেন। গত মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) রাতে অভিযান চালিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় বহিরাগত ছয় তরুণ-তরুণীকে আটক করে প্রক্টরিয়াল টিম। পরবর্তীতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে ডেইলি ক্যাম্পাসে ‘ঢাবিতে অপ্রীতিকর অবস্থায় ৬ তরুণ-তরুণী আটক’ শিরোনামে খবরও প্রকাশিত হয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় অনেক কাপলকে অপ্রীতিকর অবস্থায় আটক করে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ক্যাম্পাসের বটতলা, আমতলা, মুহসীন হল মাঠ, মল চত্বর ও শ্যাডোর মাঝের স্থান, কার্জন হলের পেছনের এলাকা, শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়সহ অনেক জায়গায় লাইটিং ব্যবস্থা কম থাকায় নিয়মিতই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অন্ধকার ও প্রশাসনের অকার্যকর ভূমিকায় প্রশ্রয় পাচ্ছে অপরাধীরা। এতে ব্যাহত হচ্ছে ক্যাম্পাসের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রক্টরিয়াল টিমের তৎপরতা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও আশানুরূপ উন্নতি দেখছেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফিলতির কারণেই এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তানজীম আহমেদ (ছদ্মনাম) বলেন, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্পটে, বিশেষ করে কলাভবন সংলগ্ন আমতলা, বটতলা ও কার্জন হল এলাকায় ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন অশালীন কাজকর্ম করছেন। কিছুদিন আগে কার্জনে ছেলে-মেয়ের আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হয়। আবার গতকাল দুটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এসব নিয়ে প্রশাসনের কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। এসবের কারণে ক্যাম্পাসের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তাছাড়া, ক্যাম্পাসে কখনো পরিবারের কাউকে নিয়ে ঘুরতে বের হলে আমাদেরকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রশাসনের উদাসীনতায় খুব বাজে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সবাই এখানে এসে অনৈতিক কাজ করছে। রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে তাকালেই কাপলদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করতে দেখা যায় হরহামেশাই। যখন আমরা পরিবার নিয়ে আসি, বিকেলের পরে ক্যাম্পাসে আসতে পারি না। প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে এটার সমাধান না করলে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বহিরাগতরাও ক্যাম্পাসকে অশ্লীলতার জন্য 'সেফ জোন' মনে করছে। যেহেতু আমাদের সমাজ অনেকটা ধর্মভীরু, বাইরে এসব করলে তাদের বাধা দেবে সবাই। কিন্তু ক্যাম্পাসের মধ্যে তাদের বাঁধা দেয়ার কেউ নেই বলে তারা অনেকটা নিশ্চিত।

ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রশাসনের উদাসীনতায় খুব বাজে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় সবাই এখানে এসে অনৈতিক কাজ করছে। রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে তাকালেই কাপলদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করতে দেখা যায় হরহামেশাই। পরিবার নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে পারি না। প্রশাসন সমাধান না করলে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। -নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রী

তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে বহিরাগতরা এভাবে অনায়াসে ঢুকতে পারছে এবং অশালীন কাজ করে যাচ্ছে। যখন আমরা পরিবার নিয়ে ঘুরি বা আমাদের গ্রাম থেকে কেউ ক্যাম্পাসে আসে, তখন খুবই অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে যাই আমরা।

এর সমাধান জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর একমাত্র সমাধান পদক্ষেপ নেওয়া। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারলে কেউ সাহস করবে না এসব কাজ করার। যদি বহিরাগত কাপলদের ধরে থানায় দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শাস্তির সম্মুখীন করা হয় এবং এসব খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন কেউ এসব অনৈতিক কাজ করতে সাহস করবে না। এভাবে কিছুদিন চলমান থাকলে এসব অনৈতিক কাজ একেবারে নির্মূল করা যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিদিন আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের তদারকি বৃদ্ধি করেছি। তারা কার্জন এলাকা ও কলাভবন এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে অনেককে আটক করছে। যেহেতু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাদের আমরা থানায় দিতে পারি না। আমরা এক এলাকা থেকে সতর্ক করে অন্য জায়গায় গেলেই নতুন কাপলরা এসে জায়গা দখল করছে এবং অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন এসব অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি না হয়। ক্যম্পাসে অনেক জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে এবং অন্যান্য এলাকায় আরও লাগানো হবে। আমরা নোটিশ বোর্ড স্থাপন করেছি, নিয়মিত কাপলদের সতর্ক করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করলে এসব আমরা দূর করতে পারবো বলে মনে করি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা নিয়মিত তদারকি করে যাচ্ছে। এখন শুধু আমরা তদারকি করলেই তো এটা দূর হবে না, শিক্ষার্থীদেরকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। তারা যেন এমন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। 

নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে খোলা থাকায় মাঝেমধ্যে এসব ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। এতে শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় মাদকাসক্ত বা বহিরাগতের অভয়ারণ্য ছিল। সেটা এখন অনেকটাই কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম একসাথে কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে।