রাবিতে ৭০ বছরে ৪০ শতাংশ আবাসিকতাও নিশ্চিত হয়নি
বরেন্দ্রভূমির প্রাণভোমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ পেরিয়ে ৭১ বছরে পদার্পণ করেছে গত ৬ জুলাই। গেল ৭০ বছরে মাত্র ৩৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসিকতা নিশ্চিত করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। আবাসনের এমন চরম সংকটের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে অনাবাসিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকাগুলোয় মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। বাইরে থাকার শিক্ষার্থীদের একাংশ জানান, অতিরিক্ত ভাড়া ও নিরাপত্তাহীনতা তাদের ভোগান্তির প্রধান কারণ
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উন্নয়নমূলক কাজগুলো দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করলে তাদের আবাসন সুবিধা কিছুটা নিশ্চিত হবে। একইসাথে আর্থিকভাবে তারা উপকৃত হবেন। শতভাগ আবাসিকতার নিশ্চয়ন চায় শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গার কোনো অভাব নেই। আছে প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে ২৬ হাজার ৩৭০ জন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৭৭ জন ছাত্র ও ৯ হাজার ২৯৩ জন ছাত্রী। আবাসনের জন্য ছেলেদের ১১টি ও মেয়েদের ৬টি হল রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে ৫ হাজার ৪৬৯ জন ছেলে শিক্ষার্থী ও ৪ হাজার ২০৪ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অবস্থা থাকছেন। বাকি ১৬ হাজার ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী আবাসিকতা পাননি।
শিক্ষার্থীরা জানান, অনেকে আবাসিক হিসেবে হলে থাকলেও অনেককেই গণরুমে থাকতে হয়। কয়েকটি গণরুমে গাদাগাদি করে থাকেন প্রায় দেড় হাজার ছাত্রী। এর মধ্যে মন্নুজান হলের চারটি গণরুমে দুই শতাধিক, তাপসী রাবেয়া হলের দু’টি গণরুমে ২৮০ জন, খালেদা জিয়া হলের দুটিতে প্রায় ২০০, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের একটিতে ২১০, বেগম রোকেয়া হলে পাঁচটিতে প্রায় ২৫০ ও রহমতুন্নেছা হলের কয়েকটি গণরুমে প্রায় ২৫০ জন ছাত্রী থাকেন। মতিহার হলের একটি গণরুমে ৫০ জন ও শহীদ শামসুজ্জোহা হলের দুইটিতে প্রায় ৪০ জন ছাত্র থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রদের জন্য ১০ তলাবিশিষ্ট শহীদ এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান হল ও ছাত্রীদের জন্য দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল নির্মিত হচ্ছে। হল দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেখানে দুই হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারবেন। যদিও তা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় খুবই নগণ্য। তবুও নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন হলে তারা উপকৃত হবেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যারা মেসে থাকেন, তারা অধিকাংশই মেস বা বাড়িওয়ালাদের কাছে অমানবিক আচরণের শিকার হন। না থেকে উপায় নেই বলে মেস-বাসাওয়ালারা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে রাখছেন ভাড়া। অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়াসহ শিক্ষার্থীদের বাড়ছে মানসিক চাপ, হতাশা ও দুশ্চিন্তা। এ বয়সেও পরিবারের বোঝা হওয়ার কথা ভেবে আঁতকে উঠছেন অনেকে।
এদিকে এসব মেসে নেই কোনো নিরাপত্তা বলয়। জানা যায়, গত ১১ মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর সংলগ্ন গেটে শিক্ষার্থী ও বাজার কমিটির সাথে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাঁধে। সহিংস হয়ে ওঠে দু’পক্ষ। একপর্যায়ে স্থানীয়রা তান্ডব চালায় আশেপাশের মেসগুলোতে। আতঙ্কে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাইরে বের হতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক ছিল খাবার সংকট। অধিকাংশ মেসে রান্না বন্ধ হয়ে যায়। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে অভিভাবকদের। শুধু এ ঘটনাই না; আগেও এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে এখানে।
আবাসনের জন্য ছেলেদের ১১টি ও মেয়েদের ৬টি হল রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে ৫ হাজার ৪৬৯ জন ছেলে শিক্ষার্থী ও ৪ হাজার ২০৪ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অবস্থা থাকছেন। বাকি ১৬ হাজার ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী আবাসিকতা পাননি।
শতভাগ আবাসিকতার ব্যবস্থা থাকলে এ সব দুর্ভোগ পোহাতে হতো না বলে দাবি করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী মো. আসলাম হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যয় হলো হল জীবন। কিন্তু আফসোস দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও হলে থাকার সুযোগ হচ্ছে না। হাজার-হাজার টাকা খরচ করে অনিরাপত্তার মধ্যে বাইরে থাকতে হচ্ছে।
তার ভাষ্য, শিক্ষার্থীদের তুলনায় হলে সিট সংখ্যা একদমই সীমিত। যেগুলো আছে তাতেও আবার বিভিন্ন কোটা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৬৯৭ একর জমিনের ওপর শতভাগ আবাসিকতার ব্যবস্থা করতে পারলেও রাবি কেন পারলো না, বুঝে আসে না। রাবি প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব ঘুচালেই এ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম বলেন, আবাসন সংকটের কারণে আমি ক্যাম্পাসের বাইরের মেসে থাকি। আবাসনের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকলে আমার হলে থাকার ইচ্ছ ছিল। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে উঠেও আমি হলে সিট পাইনি। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে ৭০ বছরেও ৫০ শতাংশও আবাসিকতার নিশ্চিত করতে পারেনি, শতভাগ তো কল্পনাতীত ব্যাপার।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, সব শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিকতা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। শতভাগ আবাসিকতা হলে সবচেয়ে ভালো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স হিসেবে আমাদের আরও হল হওয়ার দরকার ছিল। বিশেষ কিছু কারণে হয়তো সেটা সম্ভাব হয়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকে এখনো ক্যাম্পাসের বাইরের কোনো মেসে থাকতে হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। আর যাতে কোনো শিক্ষার্থীকে অনিরাপত্তায় ভুগতে না হয়, সেজন্য আমরা সরকারকে জানিয়েছি যাতে আরো দু’টি হল প্রতিষ্ঠা করা যায়। তাহলে দ্রুতই আবাসন সংকট নিরসন হবে।
উপ-উপাচার্য বলেন, আমরা নতুন করে দশ তালাবিশিষ্ট দুইটা হল প্রতিষ্ঠা করতেছি। যার ফলে অনেকটা আবাসন সংকট কমিয়ে আনবে। আমরা চাই আমাদের সকল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের ভিতরে আবাসিকভাবে অবস্থান করুক। তবে এখানে সরকার, ইউজিসি ও সংশ্লিষ্ট সবার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।