ঢাবিতে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, প্রতিরোধে নেই কার্যকর পদক্ষেপ
বর্ষা বাড়ার সাথেসাথেই সারাদেশে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। একই সাথে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীও। ইতিমধ্যেই সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০৩ জন যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রশাসনের তেমন কোন অভিভাবকসুলভ ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী থাকছে মৃত্যু ঝুঁকিও।
দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে। প্রতিদিনই আশেপাশের বন্ধু, বড় বা ছোট ভাইদের দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই যেনো দায়মুক্তি নিচ্ছে।
সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১-২ দিন ফগিং করা হলেও সেটা যথেষ্ট কার্যকরী নয় বলে ইতিমধ্যেই প্রতীয়মান হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা মো. মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্টের সরঞ্জাম না থাকায় সবাইকে ছুটতে হচ্ছে আশেপাশের মেডিকেলগুলোতে।
সরজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল বা একাডেমিক বিল্ডিংয়ের আনাচে-কানাচে জমে আছে পানি। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনের ফোয়ারা ও কলা ভবনের সামনের ফোয়ারার পানি স্থির থাকায় বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি স্থায়ী হয় বেশ কিছুদিনের জন্য। ফলে সেখানে সহজেই এডিস মশার লার্ভা ছাড়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার হলগুলোতে ডাবের খোসা, দইয়ের কাপ কিংবা ওয়ান টাইম কাপ ফেলে রাখায় পরিষ্কারের অভাবে সেগুলোতে জমে থাকছে পানি। ফলে এডিস মশা সহজেই এই পানিতে ডিম ছাড়তে পারছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দক্ষিণ সিটির অংশ হওয়ায় সকল কাজের দায়ভার তাদের উপরেই বর্তায়। তারা সপ্তাহে মাঝেমধ্যে এসে ফগিং করে যাচ্ছে। কিন্তু এই ফগিং যথেষ্ট কার্যকরী না হওয়ায় ক্যাম্পাসের যত্রতত্র এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি স্পষ্ট লক্ষণীয়।
এদিকে হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় প্রতিদিনই নতুন কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে। গত ১৫ দিনে হলের প্রায় প্রতিটি রুমেই অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থী জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা সহ ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন ডেঙ্গু চেকআপ করাতে। আবার অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে এসব প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও দুই বেলা নাপা খেয়ে শুয়ে থাকতে। ডেঙ্গু টেস্ট করানোর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে কিন্তু তাদের সতর্ক করা বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না প্রশাসনকে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মো. মোর্জতা মেডিকেল সেন্টারে নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা রোগী ধারণ ক্ষমতা। ডেঙ্গু টেস্ট করার উপকরণও নেই মেডিকেল সেন্টারটিতে। শুধু দিনে তিন ঘণ্টা সময় ব্লাড টেস্ট করানো হচ্ছে। দু-দিন আগেও মাত্র দুই ঘণ্টা ব্লাড স্যাম্পল কালেকশন করা হলেও বর্তমানে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল ৮-১১ টা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।
ফলে দিনের বাকি সময় কেউ ডেঙ্গুর সিম্পটম নিয়ে আসলেও তার টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পল রাখা হচ্ছে না। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে সেসব শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা অন্যান্য হাসপাতালে যেতে হচ্ছে টেস্ট করাতে। আবার ঢাবির মেডিকেল সেন্টারে নেই পর্যাপ্ত শয্যা। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কিংবা অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, হলগুলোতে নিয়মিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে কিন্তু হল প্রশাসন বা অন্য কাউকেই তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। মাঝেমধ্যে এম্বুলেন্স আসছে গুরুতর অসুস্থ হলের শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনই বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকিও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নিয়াজ উদ্দিন শিমুল ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছুক্ষণ পরপরই কারও না কারও ডেঙ্গু পজিটিভের খবর পাচ্ছি অথবা কেউ সিম্পটম নিয়ে টেস্ট করতে যাচ্ছে। আমার রুমমেট অনেকেই ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে। হলগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে মাঝেমধ্যে ফগিং করা ছাড়া তেমন কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা। এই প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঢাবি প্রশাসন কিংবা হল প্রশাসনের স্বদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থী-প্রশাসন সবার সার্বিক সহযোগিতাই পারে আমাদের নিরাপদ রাখতে।
আরও পড়ুন: চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারি, ৩ নেতা বহিষ্কার
শহীদ ডা. মো. মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম শামীমা পারভীন বলেন, আমরা রোগীর চাপের কারণে ইতিমধ্যেই সিভিসি টেস্টের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়েছি। এখন সকাল ১১ টা পর্যন্ত সিভিসি টেস্ট করানো হচ্ছে। আমাদের এখানে ডেঙ্গু টেস্টের সরঞ্জাম নেই, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি যেনো তারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে। তারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে ও তা মেডিকেলে পাঠাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থীর সিভিসি টেস্ট করানো হচ্ছে। প্রতিদিন কিছু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিক্ষার্থী এসে ভর্তি হচ্ছেন আবার প্রতিদিন সুস্থ হয়ে অনেকে ফিরেও যাচ্ছেন। আমরা চিকিৎসা নিতে আসা বা ভর্তি হতে চাওয়া কাউকে ফিরিয়ে দেই না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গু একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু ঔষধ ছিটিয়ে এটা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সচেতন এবং তাদের এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। আশেপাশে ময়লা না ফেলা, কোথাও পানি জমে থাকলে সেটা ফেলে দেওয়া, তাছাড়া মশারী টানিয়ে ঘুমানোটাও একটা সতর্কতার অংশ। আমরা প্রতিদিনই ঔষধ ছিটানোর কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি সচেতন না হয় তাহলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কখনো নির্মূল করা সম্ভব নয়।