০৬ জুলাই ২০২৩, ০১:১০

উচ্চশিক্ষার পট পরিবর্তনে জারি থাকুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  © ইলাস্ট্রেশন

উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনসহ নানা খাতে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে দেশের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।  ১৯৫৩ সালে যাত্রা করা এ উচ্চশিক্ষালয়টি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎপরবর্তীকালের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে বহু ত্যাগ শিকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা; সাক্ষী হয়েছেন কালের প্রবাহে বাঙালির বহু আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাফল্যের। দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে সত্য মানুষ তৈরির ব্রতে ৭০ পেরিয়ে গৌরবোজ্জল পথে নবযাত্রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষা নগরীর রাবি।

রাজশাহীর বড় কুঠিতে মাত্র ১৬১ শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল উত্তরাঞ্চলের প্রথম বড় কোনো বিদ্যাপীঠ। সময়ের পরিক্রমায় আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) ৭০ বছর পেরিয়ে ৭১ বছরে পা রাখল দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, সমাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, অভিনেতা, নাট্যকার, গবেষক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, জ্ঞানী-গুণী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব তৈরির অনন্য অবদান রেখেছে রাবি। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় প্রতিটি বিভাগেই রয়েছেন দেশের স্বনামধন্য মেধাবী শিক্ষকরা। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার জন্যও সুনাম রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির।

সুদীর্ঘ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রেখেছে সমান কৃতিত্বে। দীর্ঘ এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেছে ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মতো খ্যাতনামাদের।

শিক্ষা, সহশিক্ষা ও যুগোপযোগী মানব সম্পদ তৈরির ব্রতে উচ্চশিক্ষার ললাটে একটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো সম্পূর্ণ চিত্র বদলাতে পারবে না। কিন্তু, জ্ঞানী মানবের আবহে নীরব-আড়ালে শিক্ষার যে প্রধান উদ্দেশ্য বিলিয়ে যাচ্ছে তাই বা কম কীসের। শিক্ষার আলো জ্বালানোর মহান দায় কিংবা মানুষ তৈরির ব্রত গৌরবোজ্জল থাকুক, জারি থাকুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

নানা চড়াই উৎরাই আর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ যুগে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষা-দীক্ষা উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। সে সময়ে রাজশাহী আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণি চালু করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় এসব কার্যক্রম। সে সময়েই রাজশাহীতে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। 

পরবর্তীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন আগ থেকেই মূলত রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। 

১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়। ওই বছর অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ১৬১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।

কলা ও আইন এই দুই অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইন, দর্শন ও অর্থনীতি বিভাগ নিয়ে ১৯৫৩-৫৪ সেশনে রাজশাহী কলেজে ১৫৬ জন ছাত্র, ৫ জন ছাত্রী ও ২০ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সবুজে মোড়ানো ক্যাম্পাসটি। এখন তা ৭৫৩ একরের মহীরুহ হয়ে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর শিক্ষা বাতায়নের মহাপবিত্র স্থান হিসাবে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশের সব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় ‘স্যাডলার কমিশন’ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়।

দৃষ্টিনন্দন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজারের অধিক। ১২টি অনুষদের অধীনে ৫৯টি বিভাগ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা চলমান রয়েছে; পাশাপাশি চলছে বৃদ্ধির পরিকল্পনা। এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর গবেষণার জন্য এখানে রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও গবেষণার জন্য প্রায় ১২০০-এর অধিক শিক্ষক এবং প্রায় ২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। আরও রয়েছে ১২টি অ্যাকাডেমিক ভবন (নির্মাণাধীন একটি) ও ছাত্রদের থাকার জন্য ১১টি আবাসিক হল (নির্মাণাধীন একটি) এবং ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৬টি হল (নির্মাণাধীন একটি)।

রূপের রানি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, নান্দনিকতা, প্রকৃতির সুধা কিংবা মনোরঞ্জন যা সব কিছুই মিলবে বর্তমান এ মতিহারের সবুজ চত্বরে। ইতিহাস ও সাহসিকতার ধারক ও বাহক হয়ে মাথা উঁচু করে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে 'সাবাশ বাংলাদেশ' ভাস্কর্য। একটু সামনে এগোতেই মা ও মাটির জন্য আত্মত্যাগের স্মৃতির জাগরণ ঘটাতে চোখে পড়বে ‘জোহা চত্বর’।

প্রেম, গল্প, আবেগ কিংবা আড্ডার শত-স্মৃতির প্রেয়সী সে তো ‘প্যারিস রোড’। শহীদ মিনার, জুবেলী টাওয়ার, বুদ্ধিজীবী চত্বর, স্ফুলিঙ্গ বা চারুকলার কারুকার্য কিংবা প্রকৃতির মাধুর্যে সাজানো এ প্রাঙ্গণের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি অনিন্দ্য সৌন্দর্যের ধারক এবং বাহকও বটে।

বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে প্রদত্ত ডিগ্রিসমূহের মধ্যে রয়েছে স্নাতক (সম্মান): বিএ , বিএফএ, বিপিএ, বিএসসি, বিফার্ম, এলএলবি, বিবিএ, বিএসএস, বিএসসি এজি, বিএসসি ফিশারিজ ও বিএড। স্নাতোকোত্তর পর্যায়ে প্রদত্ত ডিগ্রিসমূহের মধ্যে রয়েছে এমএ, এমএফএ, এমপিএ, এমএসসি, এমফার্ম, এলএলএম, এমবিএ, এমএসএস, এমএস এজি, এমএস ফিশারীজ, এমএড ও এমপিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ৫৯টি বিভাগ এবং ২টি ইনস্টিটিউটে মোট ৪ হাজার ১৭৩টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে এ ইউনিটে (মানবিক)- আসন সংখ্যা ২ হাজার ১৯টি। বি ইউনিটে (ব্যবসায় শিক্ষা) আসন সংখ্যা ৫৬০টি ও সি ইউনিটে (বিজ্ঞান) আসন সংখ্যা ১ হাজার ৫৯৪টি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ১৭ টি আবাসিক হল রয়েছে। বর্তমানে মোট ৫ হাজার ৪৬৯ জন ছাত্র এবং ৪ হাজার ২০৪ জন ছাত্রী এসব হলে আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন।

দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রুকাইয়া হক রুহি তার স্বপ্ন পূরণে রাবিকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আইন নিয়ে পড়াশোনা করার। নিজের অবস্থান থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এবং আইনজীবী হিসেবে সমাজের জন্য কিছু করার। ভীষণ যত্নে আগলে রাখা এই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে নেওয়া প্রথম পদক্ষেপের কারিগর আমার প্রিয় আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আমার মতোই আরো লাখো স্বপ্নবাজ তরুণের স্বপ্ন পূরণে এ বিদ্যাপীঠের অবদান অনস্বীকার্য।

জন্মলগ্নের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তোমার প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা রইল হে প্রাণের স্পন্দন। আগামী দিনগুলোতে তোমার খ্যাতি আরো বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক গোটা বিশ্বের বুকে। চির গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেক শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে। তোমার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। শুভ জন্মদিন প্রিয় বিদ্যাপীঠ—যুক্ত করেন এই শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রেদওয়ান ইসলাম রিদয় বলেন, নানা গৌরবোজ্জ্বল অতীত নিয়ে আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭০ বছরে পদার্পণ করল আজ। দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় পয়ত্রিশ হাজার প্রাণের চাঞ্চল্যে সমাগম করে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদানে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংগ্রামে বুক পেতে দিয়ে এগিয়ে চলছে। ছায়াশীতল এই ক্যাম্পাস তাই আমাদের প্রাণের স্পন্দন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার প্রাণের বিনিময়ে স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এই প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কালে কালে তৈরি করছে হাজারো কিংবদন্তী। গুণিজনদের পদচারণায় বরাবরই মুখরিত হয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

টুকিটাকি চত্বর, ইতিহাস চত্বর, লাইব্রেরি রোড, আমতলা, আবুর ক্যান্টিন এবং প্যারিস রোড ছাড়াও ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে রয়েছে দেশসেরা শিক্ষার্থীদের অমূল্য স্মৃতির ভান্ডার। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে গর্বিত। এই ক্যাম্পাসটি এত সাজানো গোছানো যা আমার মন কেড়েছে। যা থেকে যাবে আমার মনে। এই ক্যাম্পাসে পড়ার স্বপ্ন আমার কলেজ জীবন থেকে ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।নিজের ক্যাম্পাস নিয়ে আমার অনেক ভালো লাগা কাজ করে। কেননা ক্যাম্পাসের বাতাসেও জ্ঞানচর্চা হয়; বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবীদের মিলনমেলা বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।