০৫ জুলাই ২০২৩, ১৫:০৭

৭১-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  © ফাইল ছবি

১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। রাজশাহীর বড় কুঠিতে মাত্র ১৬১ শিক্ষার্থী নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল উত্তরাঞ্চলের প্রথম বড় কোনো বিদ্যাপীঠের। সময়ের পরিক্রমায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) ৭০ বছর পেরিয়ে ৭১ বছরে পা রাখবে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নিজস্ব আলোয় আলোকিত এ বিদ্যাপীঠ। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গৌরব ও এতিহ্যে বিশ্বময় উদ্ভাসিত আজ। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সোচ্চার থাকা এ বিদ্যাপীঠের আগামীকাল জন্মদিন।

আজকের এ অবস্থানে আসতে দীর্ঘ কণ্টকময় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। ব্রিটিশ যুগে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষা-দীক্ষা উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। সে সময়ে রাজশাহী আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণি চালু করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় এসব কার্যক্রম। সে সময়েই রাজশাহীতে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। 

পরবর্তীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন আগ থেকেই মূলত রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। 

১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়। ওই বছর অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ১৬১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।

কলা ও আইন এই দুই অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইন, দর্শন ও অর্থনীতি বিভাগ নিয়ে ১৯৫৩-৫৪ সেশনে রাজশাহী কলেজে ১৫৬ জন ছাত্র, ৫ জন ছাত্রী ও ২০ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সবুজে মোড়ানো প্রিয় ক্যাম্পাসটি। 

এখন তা ৭৫৩ একরের মহীরুহ হয়ে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর শিক্ষা বাতায়নের মহাপবিত্র স্থান হিসাবে।

জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশের সব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় 'স্যাডলার কমিশন' রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়।

দৃষ্টিনন্দন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজারের অধিক। ১২টি অনুষদের অধীনে ৫৯টি বিভাগ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা চলমান রয়েছে; পাশাপাশি চলছে বৃদ্ধির পরিকল্পনা। এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর গবেষণার জন্য এখানে রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও গবেষণার জন্য প্রায় ১২০০-এর অধিক শিক্ষক এবং প্রায় ২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। আরও রয়েছে ১২টি অ্যাকাডেমিক ভবন (নির্মানাধীন একটি) ও ছাত্রদের থাকার জন্য ১১টি আবাসিক হল (নির্মানাধীন একটি) এবং ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৬টি হল (নির্মানাধীন একটি)।

রূপের রানি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,  নান্দনিকতা, প্রকৃতির সুধা কিংবা মনোরঞ্জন যা সব কিছুই মিলবে বর্তমান এ মতিহারের সবুজ চত্বরে। ইতিহাস ও সাহসিকতার ধারক ও বাহক হয়ে মাথা উঁচু করে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে 'সাবাশ বাংলাদেশ' ভাস্কর্য। একটু সামনে এগোতেই মা ও মাটির জন্য আত্মত্যাগের স্মৃতির জাগরণ ঘটাতে চোখে পড়বে 'জোহা চত্বর'।

প্রেম, গল্প, আবেগ কিংবা আড্ডার শত-স্মৃতির প্রেয়সী সে তো 'প্যারিস রোড'। শহীদ মিনার, জুবেলী টাওয়ার, বুদ্ধিজীবী চত্বর, স্ফুলিঙ্গ বা চারুকলার কারুকার্য কিংবা প্রকৃতির মাধুর্যে সাজানো এ প্রাঙ্গন এক নজরেই যে কাউকে বলতে বাধ্য এ অনিন্দ্য সৌন্দর্য কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল প্রকৃতির থেকে নেয়নি। দিয়েছে পুরো বিশ্বকে সেরা মানুষের ছোঁয়া। তৈরি করেছে লাখ-লাখ সেরাদের সেরা গুণিজন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় কুমার ভৌমিক, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম প্রমুখ।

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার প্রাণের বিনিময়ে স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনরত ড. জোহা ছাত্রদের মিছিলকে সংযত রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

তিনি চেষ্টা করছিলেন তার ছাত্ররা যাতে পশ্চিমা শাসক চক্রের লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণের শিকার না হয়। কিন্তু তাদের বর্বর আক্রোশ মুহূর্তে বিদীর্ণ করে তার বুক। ড. জোহার মৃত্যুতে সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। প্রতিবাদে নড়েচড়ে উঠেছিল আইয়ুব খানের গদি, পতন হয়েছিল সেই স্বৈরশাসকের। তারই ফলে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথের একটি ধাপ পেরিয়ে এসেছিল মুক্তিকামী বাঙালি। 

সুদীর্ঘ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রেখেছেন। দীর্ঘ এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেছে ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মতো প্রতিভাধরদের।

প্রতিষ্ঠানটির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, বৃক্ষরোপন কর্মসূচি প্রভৃতি। এসব অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অংশ নিতে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিদ্যাপীঠের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রুকাইয়া হক রুহি তার স্বপ্ন পূরণে রাবিকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আইন নিয়ে পড়াশোনা করার। নিজের অবস্থান থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এবং আইনজীবী হিসেবে সমাজের জন্য কিছু করার। ভীষণ যত্নে আগলে রাখা এই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে নেওয়া প্রথম পদক্ষেপের কারিগর আমার প্রিয় 'আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়'। আমার মতোই আরো লাখো স্বপ্নবাজ তরুণের স্বপ্ন পূরণে এ বিদ্যাপীঠের অবদান অনস্বীকার্য।

তিনি আরও বলেন, জন্মলগ্নের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তোমার প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা রইল হে প্রাণের স্পন্দন। আগামী দিনগুলোতে তোমার খ্যাতি আরো বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক গোটা বিশ্বের বুকে। চির গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেক শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে। তোমার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। শুভ জন্মদিন প্রিয় বিদ্যাপীঠ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রেদওয়ান ইসলাম রিদয় বলেন, নানা গৌরবোজ্জ্বল অতীত নিয়ে আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭০ বছরে পদার্পণ করবে কাল। দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় পয়ত্রিশ হাজার প্রাণের চাঞ্চল্যে সমাগম করে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদানে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংগ্রামে বুক পেতে দিয়ে এগিয়ে চলছে। ছায়াশীতল এই ক্যাম্পাস তাই আমাদের প্রাণের স্পন্দন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার প্রাণের বিনিময়ে স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এই প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কালে কালে তৈরি করছে হাজারো কিংবদন্তী। গুণিজনদের পদচারণায় বরাবরই মুখরিত হয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আরো বলেন, টুকিটাকি চত্বর, ইতিহাস চত্বর, লাইব্রেরি রোড, আমতলা, আবুর ক্যান্টিন এবং প্যারিস রোড ছাড়াও ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে রয়েছে দেশসেরা শিক্ষার্থীদের অমূল্য স্মৃতির ভান্ডার। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে গর্বিত। এই ক্যাম্পাসটি এত সাজানো গোছানো যা আমার মন কেড়েছে। যা থেকে যাবে আমার মনে। এই ক্যাম্পাসে পড়ার স্বপ্ন আমার কলেজ জীবন থেকে ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।নিজের ক্যাম্পাস নিয়ে আমার অনেক ভালো লাগা কাজ করে। কেননা ক্যাম্পাসের বাতাসেও জ্ঞানচর্চা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো মেধাবীদের মিলনমেলা। এই স্মৃতি বিজড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০তম জন্মদিন কাল। জন্মদিনে প্রানের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি থাকলো অসীম শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। শুভ জন্মদিন প্রাণের ক্যাম্পাস।