ছুটির বন্ধেও যে কারণে খোলা থাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সাকিব (ছদ্মনাম)। ঈদুল আজহার ছুটিতে সহপাঠীরা যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন সাকিব তখন ব্যস্ত সময় পার করছেন পড়ার টেবিলে। সরকারি চাকরির স্বপ্ন পূরণে এবারের ঈদ হলেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ শিক্ষার্থী।
নিজের পারিবারিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে সাকিব বলেন, ঈদ উদযাপনেও অর্থের প্রয়োজন। দিনমজুর বাবা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছেন। আমার পরিবারে ঈদ সেদিনই আসবে, যেদিন আমি একটা ভালো চাকরি পাবো। তাই আমার জন্য ছুটি উপভোগের চেয়ে চাকরির প্রস্তুতি অধিক জরুরি। একারণে সহপাঠীরা বাড়ি গেলেও আমি হলেই থেকে গিয়েছি।
শুধুমাত্র সাকিব নন, পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই চাকরির প্রস্তুতি নেন। এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই ছুটিতে ক্যাম্পাসেই থেকে যান। এছাড়া দারিদ্র্যতা, পারিবারিক জটিলতা, বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণেও বাড়ি ফেরেন না কিছু শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই বিভিন্ন উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও আবাসিক হলসমূহ খোলা রাখে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
জানা গেছে, ছুটিতে হল খোলা রাখার এ সংস্কৃতি বেশ পুরানো। মুক্তচিন্তা চর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন কারণে পরিবারের কাছে যেতে না পারা শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই ছুটিতে হল খোলা রাখার এ চর্চা শুরু করে।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলসমূহ খোলা রাখার এ চর্চা অব্যাহত আছে। এছাড়া হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যেও হল খোলা রাখা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলেই প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী থেকে গিয়েছেন। পরিবার থেকে দূরে ঈদ বেদনার হলেও টিউশন, চাকরির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই চাকরির প্রস্তুতি নেন। এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই ছুটিতে ক্যাম্পাসেই থেকে যান। এছাড়া দারিদ্র্যতা, পারিবারিক জটিলতা, বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণেও বাড়ি ফেরেন না কিছু শিক্ষার্থী।
যেসব শিক্ষার্থী ঈদে বাড়ি যাননি তাদের মধ্যে একজন নাবিল। হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাবিল হাসান বাড়ি যাননি কোচিংয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থী শিক্ষার্থীদের সময় দিতে। ঢাবিতে ভর্তিচ্ছুদের নিয়ে একটি ব্যাচ শুরু করেছিলেন তিনি। শিক্ষার্থী বাড়তে থাকায় তার দায়িত্বও বাড়ে।
নাবিল জানান, ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাবারের কষ্ট হচ্ছিল। তবে বাকিদের সঙ্গে সমন্বয় করে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আবার তার কোচিংয়ের শিক্ষার্থীরাও তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে বলে জানালেন নাবিল।
আরও পড়ুন: মেয়াদোত্তীর্ণদের নিয়েই বসছে জাবির সিনেট, থাকছে না ছাত্র প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি), পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (পাবিপ্রবি) বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হলসমূহ খোলা রেখে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।
হল খোলা রাখা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবদুল বাছির বলেন, বন্ধগুলো মূলত বাড়ি যাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। তারপরও কিছু শিক্ষার্থী পরীক্ষাসহ নানা কারণে হলে থাকেন। তাদের জন্য ঈদের দিন বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সকালের নাস্তায় পরোটা, ভাজি ও ডিম এবং দুপুরে থাকবে পোলাও, ডিম, মুরগির রোস্ট, খাশি বা গরুর রেজালা ও কোমল পানীয়।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলসমূহ খোলা রাখার এ চর্চা অব্যাহত আছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যেও হল খোলা রাখা হয়।
এ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটিতে আবাসিক হলসমূহও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপস্থিত না থাকাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে, প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছে শিক্ষার্থীদের একাংশের। শিক্ষার্থীদের মতে, অন্য ধর্মাবলম্বীর শিক্ষার্থীসহ যারা বিভিন্ন কারণে বাড়ি যেতে পারছেন না তাদের কথা বিবেচনা না করেই ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদুল আজহায় উপাচার্যের নিকট একাধিকবার হল খোলা রাখার দাবি জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষারর্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করেই হল বন্ধ ঘোষণা করেছে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরমান হোসেন বলেন, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় আমি টিউশন করিয়ে নিজের পড়ালেখার ব্যয় বহন করি। ঈদের পরপরই স্টুডেন্টের পরীক্ষা হওয়ায় দুইদিনের বেশি ছুটি পাইনি। এই ছুটিতে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আবার এখন হলে থাকারও সু্যোগ নেই।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন আচরণ কাম্য নয়। আমাদের অনেক ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সহপাঠী রয়েছেন, অনেকের ব্যক্তিগত সমস্যা রয়েছে। প্রশাসন প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারে কিন্তু কাউকেতো জোর করে বাড়ি যেতে বাধ্য করতে পারে না।
এ বিষয়ে চবি প্রশাসন বলছে, তারা হল সংস্কারের জন্য হল বন্ধ ঘোষণা করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের হলগুলোতে কিছু সংস্কার কাজ প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য কিছু বরাদ্দও এসেছে। আমরা এই ছুটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। এজন্য হল বন্ধ রেখে সংস্কার কাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অধ্যাপক ফরিদুল আলম বলেন, কেউ হলে থাকতে চাইলে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে প্রভোস্ট বরাবর জমা দিতে হবে। সেই আবেদন গ্রহণযোগ্য হলে অনুমতি সাপেক্ষে হলে থাকতে পারবেন আগ্রহী শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তাদের হল বন্ধের বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত ছিল। নিয়মের বাইরে গিয়ে হল খোলা রাখার সুযোগ নেই। উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, হল বন্ধের ব্যাপারটা বছরের শুরুতে দেওয়া একাডেমিক ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী পূর্ব নির্ধারিত। উপাচার্য চাইলেও নিয়ম বহির্ভূত হয়ে হল খোলা রাখার সুযোগ নেই।