রাবিতে বাঁশি বিক্রি করেই পার হয়ে গেছে ৩৬ বছর
বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর মুখে বিভিন্ন গানের সুরেলা সুরে বাঁশি বাজিয়ে ৩৬ বছর পার করেছেন তিনি। কীভাবে বাঁশি বাজাতে হয় তা আবার ক্রেতাকে শিখিয়ে দেন। পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, বিচ্ছেদ ও পুরোনো বাংলা সিনেমার গানের সুরও তুলতে পারেন। আবার নিজেও তৈরি করেন গান, সুর-তালও দেন। বাঁশির প্রতি প্রবল আকর্ষণ তাকে এই পেশা থেকে কখনোই আলাদা করতে পারেনি। তাই ব্যক্তি জীবনের উত্থান পতনে বাঁশি বিক্রিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি।
বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসে বাঁশি বিক্রেতা গনেশ চন্দ্র দাসের কথা। ৩৬ বছর যাবৎ এই ক্যাম্পাসেই বাঁশি বিক্রি করেন তিনি। যা দিয়েই কোনো রকম খুঁড়িয়ে চলছে তার সংসার। ইচ্ছে ছিল কোনো একটা চ্যানেলে গান করার। আমৃত্যু ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সুর সঙ্গীতের ঐতিহ্য। তবে মূল্যায়িত হয়নি তার প্রতিভা। কেউ তার প্রতিভার মূল্যায়নে এগিয়ে আসেনি। তাইতো অভিমানে বারবার ছেড়ে দিতে চেয়েছেন এই পেশা। কিন্তু ভালো লাগা ও আবেগের কাছে হার মানে সকল অভিমান।
গনেশ চন্দ্র দাস রাজশাহী নগরীর পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা। তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। তিন ছেলেই বিবাহিত। তবে ১৫ বছর আগে চিকিৎসার অভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার একমাত্র মেয়ে। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি তার। তারপরও নিজের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবিকার খোঁজে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি গনেশ চন্দ্র।
তার সাদামাটা জীবনে নেই কোনো বিলাসিতা। দু'বেলা দুমুঠো ভাত কখনো জঠরে দিতে পারলেও আবার কখনো অর্ধাহারে কাটিয়ে দেন তিনি। জীবিকার তাগিদে অন্য ১০ জনের মতোই ছুটতে হয় তাকেও। সকল দুঃখ কষ্ট হাসি মুখে বরণ করার এক বিষ্ময়কর শক্তি নিয়েই যেন পৃথিবীতে নিরন্তর ছুটে চলা পরিশ্রমী এই মানুষটির।
জীবন যুদ্ধে লড়াকু এই মানুষটির সাথে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। আলাপকালে নিজের একান্ত সুখ দুঃখের অব্যক্ত গল্পগুলো শোনালেন হাসিমুখেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা বাঁশি ভর্তি একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেন ক্যাম্পাসের দিগ্বিদিক। সকালের পাখি ডাকা ভোর আর সূর্য গড়িয়ে সন্ধ্যা, সারাদিনই বিচরণ ঘটে তার। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি খুব পরিচিত একটা মুখ। ক্যাম্পাসের প্রায় সবখানেই দেখা মেলে তার।
আলাপকালে হাসি মুখে গণেশ চন্দ্র বলেন, আমি এ ক্যাম্পাসে তিনযুগ ধরে বাঁশি বিক্রি করছি। এক সময় পেশা হিসেবে বাঁশি বিক্রি করেই আমার সংসার ভালোভাবে চলে যেত। কিন্তু এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রায় ৬০ হাজার টাকা লাগবে। তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারি না। আগের মতো বাঁশি বিক্রি না হওয়ায় খুব অভাব-অনটন আর মানসিক অবসাদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার দিন।
তিনি বলেন, ৩৬ বছর আগে এই ক্যাম্পাসে বাঁশি বিক্রির আলাদা একটা হিড়িক ছিল। আমার ব্যবসা ছিল রমরমা অবস্থা। তখন মানুষের সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আবেগ ও আস্থা ছিল। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে ততই মানুষের সঙ্গীতের প্রতি আবেগ-অনুভূতি কমে গিয়েছে। তাছাড়া যখন থেকে ডিস-ইন্টারনেট আর মোবাইলের আবিষ্কার হয়েছে, তখন থেকেই সঙ্গীতের প্রতি মানুষের আস্থা হারাতে শুরু হয়েছে। যা এখন প্রায় তলানিতে পৌঁছেছে। ভাটা পড়েছে আমার বাঁশি বিক্রিতেও।
এখন কেমন বাঁশি বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে একটি ব্যাগে করে শতাধিক বাঁশি নিয়ে বের হই। কোনো দিন ৪-৫টি বাঁশি বিক্রি হয়, আবার কখনো একটি বাঁশিও বিক্রি হয় না, ফিরতে হয় খালি হাতেই।
বাঁশির দাম নিয়ে তিনি বলেন, বাঁশির বিভিন্ন গ্রেড আছে। সে অনুযায়ী বাঁশির দাম নিয়ে থাকি। কোনোটি ১৫০ টাকা, কোনোটি ২২০, আবার কোনোটি ৪০০ টাকা। তবে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বাঁশিও রয়েছে তার ঝুলিতে। বাঁশ কিনে তিনি নিজেই এই বাঁশিগুলো তৈরি করেন।
ভবিষ্যতে এ পেশা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদিও এখন আর তেমন বাঁশি বিক্রি হয় না। তবে এই পেশাকে আমি ছাড়তে চাই না। আমৃত্যু এই পেশাতেই থাকতে চাই। কারণ ৩৬ বছর ধরে যে বাঁশির উপর আমার জীবিকা নির্বাহ হয়ে আসছে, আশা করি বাকি দিনগুলোও তার উপর দিয়েই কাটবে।
আলাপের শেষ পর্যায়ে বিষন্ন মুখে তিনি বলেন, আমি যতই বাহিরে হাসিখুশি থাকি না কেন আমি মানসিক অবসাদে আছি। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। টানাটানির সংসারে যেখানে দু'বেলা খেতেই পারি না, সেখানে তার চিকিৎসা করানো আমার জন্য খুবই কষ্টের ব্যাপার। ছেলেরা কেউ সহযোগিতা করে না। আমি কখনো কারো কাছে হাত পাতিনি। তবে এখন আমি নিরুপায়। কেউ যদি আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় এগিয়ে আসতো তাহলে তার চিকিৎসাটা করানো যেত। কেউ যদি আমাকে ২ টাকা দিতে চান তাহলে ০১৭৩৪৯৮২৮০১ এই নাম্বারে পাঠালে আমি পাব।