৮ বছর ধরে নিয়োগ বন্ধ, শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে ঢাবির শতবর্ষী বিভাগ
১৯২১ সালে ১২টি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) যাত্রা শুরু। এসব বিভাগের মধ্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ছিল একটি। বর্তমানে শতবর্ষী এই বিভাগটি ধুঁকছে শিক্ষক সংকটে। এ কারণে একদিকে বিভাগটির শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান ব্যহত হচ্ছে। অন্যদিকে, পাশ করে বের হওয়া ভালো ফল অর্জন করা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারছেন না। সম্প্রতি বিভাগটিতে দুইজন শিক্ষক (প্রভাষক) নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মূহূর্তে তা স্থগিত হয়ে যায়।
জানা যায়, বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং, অনৈক্য এবং অন্তর্কোন্দলের জেরে দীর্ঘ ৮ বছর যাবৎ শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। কোন প্রভাষক না থাকায় দুইটি পদ খালি ২০১৯ সাল থেকেই। মাত্র ৯ জন শিক্ষক নিয়েই চলছে শতবর্ষ অতিক্রম করা এই বিভাগটি। গত ১৭ মে এই বিভাগের প্রভাষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিভাগের কিছু বিতর্কিত বিষয় সামনে আসায় সেটাও স্থগিত হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ অধিভুক্ত এই বিভাগের অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট ৩৫৫ জন। আর বিভাগে প্রতি ব্যাচের কোর্স সংখ্যা তিনটি করে। আর এই ৫ ব্যাচের জন্য মোট শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৯ জন। যাদের মধ্যে আবার ৬ জনই অধ্যাপক। দুইজন সহযোগী অধ্যাপক ও মাত্র একজন সহকারী অধ্যাপক। শিক্ষক সংকট থাকায় একজন অধ্যাপক কখনো ৩ থেকে ৪টি কোর্সে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন, যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভাগটির একাধিক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ার পেছনে বিভাগের শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দলই দায়ী। শিক্ষক সংখ্যা কম হলেও শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং এবং অনৈক্যই শিক্ষক নিয়োগের অন্তরায়। এজন্য বঞ্চিত হচ্ছেন ভালো ফলাফল করে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীরা। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. বাহাউদ্দীন।
আরও পড়ুন: স্থগিত হলো ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভাইভা বোর্ড
এদিকে, সম্প্রতি বিভাগের দুইজন শিক্ষক নিয়োগ ভাইভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মূহূর্তে তা স্থগিত হয়ে যায়। এর আগে ২০২২ সালের ১৭ মে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে দুইটি প্রভাষক পদের জন্য ৩৮ জন নিয়োগ প্রত্যাশী আবেদন করেন।
সম্প্রতি ভাইবা বোর্ড বসার কথা ছিল। তবে এই ভাইবা বোর্ডে সকল পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িক স্থগিত থাকা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক বাহাউদ্দীনকে রাখায় সমাচনার জন্ম দেয়। ফলে বোর্ড সভাপতি ও ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) বোর্ড স্থগিত করেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। পূর্বেও এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল হওয়ায় বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতার জন্য বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইউজিসির মানদণ্ড অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক ও ছাত্রের অনুপাত হওয়ার কথা ১:২০। কিন্তু সেখানে ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সেই অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ। যেখানে মানদণ্ড হিসেবে অন্তত ১৭-১৮ জন শিক্ষকের পাঠদান করানোর কথা সেখানে মাত্র ৯ জন শিক্ষক নিয়েই পাঠদান চলছে। আবার এই বিভাগে নেই কোন প্রভাষকও৷ সেই হিসেবে ফারসি বিভাগে আরও ৬-৭ জন শিক্ষক প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য।
দীর্ঘ ৮ বছর নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রভাষকের শূন্য পদ দুটি প্রায় ৪ বছর ধরে খালি পড়ে আছে। করোনা মহামারীর আগে ২০২০ সালে দুইজন শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও বিভিন্ন কারণে বাতিল হয় সেবারের নিয়োগ। এর আগে ২০১৪ সালে দুইজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলো বিভাগটি। তখন দুইজন নিয়োগ দেয়া হলেও একজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার নিয়োগ বাতিল করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শতবর্ষী অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকের সাথে তুলনা করে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৪৭ জন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ৩৮ জন, গণিত বিভাগে ৩০ জন, অর্থনীতি বিভাগে ৩৪ জন, ইংরেজি বিভাগে ৩২ জন, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২৪ জন, আরবি বিভাগে ২৪ জন, দর্শন বিভাগে ২৩ জন, বাংলা বিভাগে ২৩ জন। শুধু উর্দু আর ফারসি বিভাগেই শিক্ষক সংখ্যা মাত্র ৯ জন করে। সে হিসেবে ঢাবির অন্যান্য বিভাগ সমূহে প্রায় তিনগুণ শিক্ষক রয়েছে উর্দু-ফারসি বিভাগের তুলনায়।
সার্বিক বিষয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. বাহাউদ্দীন বলেন, এত কম শিক্ষক দিয়ে বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো অনেক কষ্টকর। একজন শিক্ষকের এক্ষেত্রে ৩-৪টি কোর্সও নিতে হয় যা অনেকটা কষ্টকর।
দীর্ঘ ৮ বছর কেন নিয়োগ হয়নি এটার সদুত্তর বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যানরা দিতে পারবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা নিজেদের দূর্বলতার জন্য নাকি প্রশাসনিক সমস্যার জন্য নিয়োগ দিতে পারেননি সেটার উত্তর আমার কাছে নেই। তবে আমি চেয়ারম্যান হবার পরেই শূন্য পদগুলোতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০২২ সালের ১৭ মে আবেদনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও প্রশাসনিক ভবনের কাজের ধীরতার জন্য এক বছর পরে ভাইভার তারিখ দেওয়া হয়।
করোনা পূর্ববর্তী ভাইবা বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেটা তৎকালীন চেয়ারম্যান স্যার ভালো জানেন কেন বাতিল হয়েছে। আমি এটা ভালো বলতে পারবো না। নিয়োগ না হবার পেছনে শিক্ষকদের মাঝে বিরোধের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষকদের মাঝে সম্পর্ক ভালো রয়েছে।
ভাইভা স্থগিত কেন হলো এবং পরবর্তী ভাইভা কবে হবে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপ-উপাচার্য স্যারের ব্যাস্ততার জন্য তিনি সেদিন আমাদের বিভাগের ভাইভাসহ আরও দুইটা ভাইভা স্থগিত করেন। এটা উনার ব্যাক্তিগত এখতিয়ার যে স্যার আবার কবে ভাইভার তারিখ দিবেন। তবে আমাদের একটা প্রয়াস থাকবে যেনো প্রশাসন নতুন একটা তারিখ নির্ধারণ করে দ্রুততার সাথে পুনরায় ভাইভা সম্পন্ন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় এবং আমাদের বিভাগের শিক্ষক সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের কাছে যদি বিভাগ এসে না বলে তাদের সমস্যাগুলো বা তাদের শিক্ষক সংকটের কথা আমরা না জানি তাহলে তো আমরা কিছু করতে পারি না। আমার কাছে যখন ফারসি বিভাগ শিক্ষক নিয়োগ চাইলো আমি সাথে সাথেই সাক্ষর করে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছে, এর আগে পরের ঘটনা আমার জানা নেই।
প্রভাষক ছাড়াই বিভাগটিতে শ্রেণি কার্যক্রম চলছে—এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই এমন প্রভাষক ছাড়া চলছে৷ একজন শিক্ষক নিয়োগের তিন বছরের মধ্যেই সে প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে ফলে নিয়মিত যদি নিয়োগ চলমান না থাকে তাহলে এই পদগুলো খালি থেকে যায়। তাছাড়া ফারসি বিভাগে কয়টি পদ খালি আছে তারা ভালো জানে এবং সে অনুযায়ী তাদের উচিত নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। সম্প্রতি বোর্ডে বিতর্কিত কেউ থাকার কারণেই আমি ভাইভা স্থগিত করেছি। আর সময় হলেই নতুন বোর্ড গঠন করে ভাইভা সম্পন্ন হবে বলেও জানান তিনি।