কংক্রিটের জঙ্গল ঢাবি, খোলামেলা ও স্বস্তিতে শ্বাস নেওয়ার জায়গা কমেছে
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৪০ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থীর আবেগের স্থান। সময় পেলেই খোলা স্থানগুলোয় আড্ডাসহ নানান কাজে পাওয়া যায় তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাখো শিক্ষার্থীরও প্রিয় ক্যাম্পাস। ছুটির দিনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে, এক পলক দেখতে ছুটে আসেন আগে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা। তবে একসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ থাকলেও কালক্রমে সেই সবুজ ক্যাম্পাস এখন ইট পাথরের দেয়ালে আবদ্ধ। ফলে এখন আর কেউ ক্যাম্পাসে এসে স্বস্তি পান না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শত সহস্র যানবাহনের হর্ণ, স্থানীয় কিংবা বহিরাগতদের অত্যাধিক আনাগোনায় ক্যাম্পাসে এখন আর শান্ত পরিবেশ নেই। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ২৮৩ একর। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে ১৯২১ সালে এর মোট জমির পরিমাণ ৬৪০ একর ছিল বলে প্রচলিত তথ্য রয়েছে। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর ১০০ বছর পার হলেও এর আয়তন কমেছে দ্বিগুণেরও বেশি।
আবার যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটুকুও যেন প্রাতিষ্ঠানিক ভবন, হল, আবাসিক ভবন দিয়েই ঘেরা। যতটুকু জায়গা খালি ছিল কিংবা শিক্ষার্থীদের স্বস্তির জায়গা ছিল, সেটুকুও এখন নানা স্থাপনায় পূর্ণ হতে চলছে। ক্যাম্পাসের মল চত্বরের অংশটি একসময় ছিলো হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট খেলার স্থান। আবার আইইআর ইইনস্টিটিউটের সামনের দুইটি সবুজ চত্বরে ছিল শিক্ষার্থীদের আড্ডা কিংবা গ্রুপ স্টাডি করার জায়গা। কিন্তু শতবর্ষী স্থাপনা সেই আড্ডা কিংবা খেলার জায়গাটা পণ্ড করে দিয়েছে।
একইসঙ্গে মেট্রোরেলের একটি স্টেশন টিএসসিতে হওয়ায় যান্ত্রিকতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। দীর্ঘদিন কাজ চলমান থাকায় এবং ক্যাম্পাসের মাঝ বরাবর এমন স্টেশন দেয়ার বিরোধিতা করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে রিক্সার পরিমান বেড়ে যাওয়া, সিএনজির লাগামহীন চলাচল প্রাইভেট কারের আধিক্যের পাশাপাশি রাতে চলছে করে বড় ট্রাকও। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ও শতবর্ষী মনুমেন্ট স্থাপনে জায়গা নির্ধারণ করে ঘেরা হয়েছে মল চত্বরের বিশাল একটা অংশ। কাজও চলছে খুবই দ্রুতগতিতে।
এ মনুমেন্টে ক্যাম্পাসের সুনাম বৃদ্ধি করলেও হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে ক্যাম্পাসের ইকোসিস্টেম। এসবের ভিড়ে শান্ত ও নির্মল প্রাকৃতিক ক্যাম্পাস থেকে ঢাবি বেরিয়ে গেছে বহু আগেই। হলপাড়া হিসেবে খ্যাত এলাকাটির পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। একই স্থানে এখন পাশাপাশি ছয়টি হল। ফলে সেখানেও কমেছে গাছপালা আচ্ছাদিত খোলা যায়গা। যেটুকু ছিল, সেখানেও চলছে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ।
ক্যাম্পাসের রোকেয়া হল, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে, শিববাড়ী এলাকা ও অমর একুশে হল এলাকায়ও নতুন নতুন বিশালাকার ভবন উঠেছে। এসব ভবনের জন্য হারিয়ে গেছে খোলা জায়গা। গত কয়েক বছরের সড়কের পাশসহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য গাছ কাটা হয়েছে। ঝড়ে উপড়ে বা ভেঙে গেছে অনেক গাছ।
শান্ত ও নির্মল বাতাস শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটায়। মানব শরীরকে রাখে রোগ মুক্ত। কিন্তু যখনই মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে কৃত্রিম হওয়া শুরু করে সেটা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই সুন্দর হোক, সেটা মানবসমাজের জন্য নানাভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু মানুষই নয়, এর প্রভাব পড়ে গাছ, পাখি কিংবা অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের জীবের ওপরও।
২০১২ সালে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা এক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাবি ক্যাম্পাস শুধু যান্ত্রিক না, মহা যান্ত্রিক হয়ে গেছে। মনে হয় রসহীন, মায়াহীন এক ক্যাম্পাস এটা। আগে মল চত্বরে বসার মত সুন্দর জায়গা ছিলো, একটু হাঁটাচলা করা যেতো। এখন সেটিও শেষ হয়ে গেছে। আমরা যখন ক্যাম্পাসে ছিলাম, এতটা ইট-পাথুরে দেয়ালে আবদ্ধ ছলো না ক্যাম্পাস।
তার ভাষ্য, এখন ক্যাম্পাসের কলা অনুষদ ও আশেপাশের এলাকায় নেই কোনও নিরিবিলি পরিবেশ যেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে একটু স্বস্তিতে থাকা যাবে। ঢাবির শিক্ষার্থীরাও মায়া মমতাহীন যন্ত্রদানবে পরিণত হচ্ছে। অথচ ক্যাম্পাস একটু প্রাকৃতিক হলে এর সুন্দর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ হতো।
আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত আহমেদ আরাফাত বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসের মল চত্বরে বর্তমানে শতবর্ষী মনুমেন্ট তৈরির কাজ চলমান। সবুজ মাঠে খননের কাজ চলছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ইট পাথরের সৌন্দর্য কখনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে নয়। এখন পর্যন্ত আমার কাছে মল চত্বরের আগের অবস্থাই ভালো ছিলো। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবাধ গাড়ির চলাচলের কারণে যানজটের সৃষ্টি।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝে রাস্তা পারাপারের সময় ভয়ে থাকা লাগে যে, কখন কোন গাড়ি সাথে ধাক্কা লেগে যায়। অন্যদিকে দেখা যায়, অধিক গাড়ি চলাচলের কারনে অনেক বেশি শব্দ দূষণ হয়। যার অনেকটা প্রভাব গিয়ে পরে শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমে বা রিডিংরুমে। তাছাড়া আমার মনে হয় প্রশাসনের উচিৎ ক্যাম্পাসে চলাচলের সুবিধার্থে নির্দিষ্ট কিছু রিক্সা নির্দিষ্ট করা ও বাহিরের অতিরিক্ত রিকশা ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়া।
আরো পড়ুন: ভোরে লাইনে দাঁড়িয়েও সিট মেলে না ঢাবি শিক্ষার্থীদের
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কানিজ আমিনা ফারিহা বলেন, আমাদের সবুজ ক্যাম্পাসটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমরা এসব দালানকোঠা চাই না। আগে রাস্তার যে সৌন্দর্য ছিলো সেটা, একদমই নষ্ট হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস সবুজই সুন্দর লাগে, দালানকোঠা, স্থাপনা ভালো লাগে না কারও। এখন এখানে গর্ত ওইখানে গর্ত। সবুজ চত্বর মল চত্বরে বসা যায় না।
এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অবশ্যই কোনও স্থাপনা তৈরী করতে হলে সেখানের পরিবেশের ক্ষতি হয়, বাস্তুসংস্থানের ব্যতয় ঘটে। কিন্তু আপনারা জেনে থাকবেন যে, শতবর্ষী মনুমেন্ট করতে আমরা একটি গাছও কাটিনি। তবে ছেলেদের খেলার জায়গা নষ্ট হয়েছে, আড্ডা দেয়ার জায়গা নষ্ট হয়েছে।
তিনি বলেন, যখন এই স্থাপনাটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে তখন সেখানে আরও সুন্দর একটি পরিবেশ পাওয়া যাবে এবং সবার বসারও সুন্দর পরিবেশ পাবে। তবে আমরা সুন্দর পরিবেশের জন্য ফুল গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টা করবো, যা শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যাম্পাসটা যান্ত্রিক হচ্ছে সেটি আমিও মনে করি। তবে সেটা শতবর্ষী মনুমেন্টের জন্য নয়। হ্যাঁ, এটি তৈরীতে একটু সময় লাগায় শিক্ষার্থীদের সাময়িক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এই মনুমেন্ট একটি ল্যান্ডস্কেপ সদৃশ হবে যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করবে। তখন শিক্ষার্থীরা ভালো একটি বসার জায়গা পাবে ও ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা জানি সারাদেশেই যানবাহন বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্যাম্পাসের যান চলাচলও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ক্যাম্পাসের ৬-৭ টি গেইট দিয়ে যানবাহন চলাচল করায় এটির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। ফলে ক্যাম্পাস হয়ে আছে অনেক অরক্ষিত যা পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে রাস্তাগুলো হওয়ায় তারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই আমরা কিছু বলতেও পারি না। তবে আমিও মনে করি আমাদের আরও সতর্ক হয়ে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। যেন শিক্ষার্থীরা সুন্দর মনোরম ও নিরিবিলি একটি ক্যাম্পাস পায়।
উল্লেখ্য, শতবর্ষী মনুমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মলচত্বরে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে শতবর্ষী মনুমেন্ট স্থাপন করা হচ্ছে। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর) সকালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভ অসীমতার স্তম্ভে বিশালতা, অন্তর্ভুক্ততা ও উদারতা’-এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবান্বিত শতবর্ষের প্রকাশ হিসেবে ১০০টি বাতি থাকবে এবং ২০টি ইতিহাস ফলক নির্মাণ করা হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা, সাইকেল স্ট্যান্ড, রিসাইকেল বিন, চার্জিং পয়েন্টসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থাকবে। চত্বরে বিদ্যমান সব বৃক্ষ অক্ষত রেখেই পেভমেন্ট, রোড, ড্রেন ও বৈদ্যুতিক কাজ সম্পন্ন করা হবে। মনুমেন্টটি ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হবে বলে জানা গেছে।