ভোরে লাইনে দাঁড়িয়েও সিট মেলে না ঢাবি শিক্ষার্থীদের
কাক ডাকা ভোরে সামনে ব্যাগের সারি। আশেপাশে নেই কেউ। কিছুক্ষণ পর এক দু’জনের আনাগোনা শুরু হয়। ৭টা বাজতে না বাজতেই প্রতিটি ব্যাগ উঠে যায় কারও না কারও কাঁধে। এরপর শুরু হয় ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। কে কার আগে যেতে পারবে চলে সেই প্রতিযোগিতা। যুদ্ধ করে ঢুকতে পারলেও অনেক সময় সিট মেলে না। পরে মনে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়।
জায়গাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত দৃশ্য এটি। এভাবে সংগ্রাম যারা করেন, তাঁদের অধিকাংশই পড়ছেন চাকরির পড়া। ক্লাসের পড়া বা গবেষণার জন্য খুব কম শিক্ষক-শিক্ষার্থীই যান সেখানে। চাকরি প্রত্যাশীদের ভিড়ে সেখানে ঠাই মেলে না গবেষণা বা কোর্স পড়ার জন্য যাওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
জানা গেছে, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যত দিন গেছে সমস্যাগুলো আরো বেড়েছে। সাম্প্রতিককালে আবাসন সংকটের সঙ্গে লাইব্রেরি সমস্যা যেন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। তবে লাইব্রেরি সমস্যাটা যেন কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে সব সময়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের। শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন। শিক্ষার্থী মাত্র ৮৭৭ জন। এরপর তা বেড়েছে কয়েকগুন। এখন প্রায় ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক দুই হাজারের বেশি। কিন্তু সে তুলনায় লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে সামান্য। লাইব্রেরী অনেক ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এখনো অধরা। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে একসঙ্গে সব মিলিয়ে কয়েকশ’ ছাত্র-ছাত্রীই লেখাপড়ার সুযোগ পান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক দিবসগুলোয় সকালে লাইব্রেরী খোলার সময় সকাল ৮টা। খোলা থাকে ১০টা পর্যন্ত। তবে বসার জায়গা পেতে শিক্ষার্থীরা সংগ্রাম শুরু করেন ভোরে। দেড় থেকে দুই ঘন্টা কিংবা তারও আগে লাইনে দাঁড়ান। অধিকাংশই আসেন চাকরি কিংবা বিভাগীয় পড়াশোনার জন্য। গবেষণা কিংবা অন্য কাজের জন্য যান কালেভদ্রে। ফলে ধুলা জমে গেছে মূল্যবান হাজার হাজার বইয়ে। শিক্ষকেরা তো এখন লাইব্রেরীমুখী হন না বলতে গেলেই চলে। কিছু শিক্ষক আসলেও অল্প সময় থেকে যান।
এহসানুল হক মেসকাত বলেন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির একটা সলিউশন বের করা দরকার। যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলেন, প্রত্যেকটি চেয়ারেই সবাই পড়ছে, তখন যদি সিট না পান, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্ত দেখবেন, লাইব্রেরিতে প্রত্যেকটা টেবিলই বই দিয়ে দখল করা, অথচ চেয়ারে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীও বসা নেই। টেবিলে একটা বই রেখে দখল করে রেখে যে যার মতো বাইরে ঘুরছে, কিংবা টিউশনিতে গেছে।
তিনি বলেন, এমনটা হতে পারে যে, কেউ অনেকক্ষণ একটানা পড়ে এক কাপ চা কিংবা পানি পান করার জন্য বাইরে গেল। কিংবা ফ্রেশ হওয়ার জন্য ১০/১৫ মিনিটের জন্য বই টেবিলে রেখে বাইরে গেল। এসব মানা যায়। কিন্তু বই রেখে কেউ বেড়াতে যায়। কারোর ৫-৬ ঘন্টায়ও খবর থাকে না। এ সময়গুলোতে অনেকে লাইব্রেরিতে এসে সিটে বই রাখা দেখে মন খারাপ করে লাইব্রেরি বের হয়ে যায়। এসব মানা যায় না।
লাইব্রেরীর করুন দশা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিষয়টি কর্তৃপক্ষেরও জানা। কিন্তু অজানা কারণে সমস্যার কোন সমাধান তো নেইই, এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ আছে কি না তাও জানেন না শিক্ষার্থীরা। গবেষণার জন্য যেসব আসন নির্ধারিত সেগুলোও ফাঁকা থাকে না। ফলে যারা এমফিল, পিএইচডি কিংবা গবেষণার কাজে যান, তারা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের লাইব্রেরিতে সিট সংখ্যা সীমিত। কিন্তু অনেকেই একাধিক সিট ধরে রাখে। দীর্ঘক্ষণ লাইব্রেরির বাইরে থাকে। এসময় কেউ চাইলেও সিটে বসতে পারে না। আবার অনেক বহিরাগতও লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে। এসব সমধানের জন্য কর্তৃপক্ষের বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নেই।
আরো পড়ুন: ছাত্রীকে প্রেম নিবেদনের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ শিক্ষার্থীদের
মো. মাসুদ রানা বলেন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি শনিবারেও সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখার জোর দাবি জানাচ্ছি। আর লাইব্রেরিতে ঢুকতে ঢুকতেই ১৫-২০ মিনিট চলে যায়। অনেকের সকালে ক্লাসও থাকে। তাই ১০ মিনিট আগেই প্রবেশের ব্যবস্থা করা হলে ভালো হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন কিংবা ক্লাসরুম সঙ্কট নিরসনে কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে প্রশাসন। ফলে কিছুটা হলেও সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলেছে। তবে দীর্ঘদিন লাইব্রেরীর সমস্যা নিয়ে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আসন সঙ্কটসহ অন্য সমস্যা সমাধান করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. নাসিরউদ্দিন মুন্সীকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। উপ-গ্রন্থাগারিক দিলীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, নতুন লাইব্রেরি কমপ্লেক্সের বিষয়ে আলোচনা চলছে। শিগগিরই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা করছি। সমস্যাগুলোরও সমাধান হচ্ছে। লাইব্রেরি ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সময় আর বাড়ানো হয়তো সম্ভব নয়।
উপ গ্রন্থাগারিক (প্রশাসন) মো. নোমান হোসেন বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সবসময়ই জোর দিয়ে বলে থাকি তারা যেন অন্যের জন্য জায়গা না রেখে দেয়। যার ফলে একজন সকাল থেকে অপেক্ষা করেও জায়গা পায় না। আবার আমরা তাদের জোর দিয়ে বলি, তারা যেনো বই খাতা রেখে হারিয়ে না যায়। ৪-৫ ঘন্টার জন্য চলে গেলে অন্য একজন শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী হয় এবং জায়গার অভাবে পড়তে পারে না। তবে বহিরাগতরা লাইব্রেরিতে পড়ছে এবং কিছুদিন আগে ৬ জন বহিরাগতকে শনাক্ত হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরের বিষয়ে অস্বকৃতি জানান তিনি।