কেমন আছেন চোখ হারাতে বসা রাবির তিন শিক্ষার্থী
‘বড় ভাইয়ের শরীরে যখন রাবার বুলেট চালায়, তখন তাকে উদ্ধারের জন্য ছুটে যাই। তাকে নিয়ে আসার সময় আমরা পুলিশকে বলছিলাম, আমরা চলে যাচ্ছি। কিন্তু পুলিশ আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে রাবার বুলেট ছুড়ে। এসময় দুটি বুলেট আমার এক চোখে এসে পড়ে। এছাড়া মাথা ও পুরো শরীরে গুলি লাগে। ফলে আমার এক চোখ হারাতে বসেছি। আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় রেফার করেছে।’
এক চোখ বন্ধ রেখে এভাবে বলছিলেন শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষের সময় আহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী আলিমুল সাকিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। পুলিশের রাবার বুলেট তার চোখে পড়ায় গুরুতর আহত হন তিনি। তার চিকিৎসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চলবে না। তাই তাকে আজ ঢাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শুধু আলিমুল সাকিব নন, আরও দুই শিক্ষার্থী রাবার বুলেটে তাদের চোখ হারাতে বসেছে। তাদেরকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য আজ ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। অন্য দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন ইসলাম। তার দু’চোখেই রাবার বুলেট লাগায় তাকাতে পারছেন না। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। বিষয়টি জানান সহপাঠীরা।
আরেক শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজ। তার চোখ ইটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। তাকেও ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। গত শনিবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় বাসের ভাড়া নিয়ে এক রাবি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জের ধরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর রাতভর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
এদিকে সংঘর্ষে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এরমধ্যে শতাধিক শিক্ষার্থী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অনেকেই সুস্থ হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছয়জন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেককেই ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। তাদেরকে দেখতে গত রোববার (১২ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেখতে আসেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় দু’চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাতে পারছেন না আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আল-আমিন আকাশ। দুচোখ বন্ধ রেখে সংঘর্ষের রাতের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, আমরা সবাই নিরস্ত্র ছিলাম। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হওয়ার সময় পুলিশের সহযোগিতায় স্থানীয়রা আমাদের ওপর ইট-পাটকেল ও পেট্রোল বোমা ছুড়ছিল। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে স্থানীয়রা পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা বিনোদপুর গেট খুলে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান করলে পুলিশ পানি ছিটাতে শুরু করে। আমরা ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে আসছিলাম। তখন পুলিশ অতর্কিতভাবে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। আমার দুই চোখে গুলি লাগায় আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ছাত্রদের ওপর পুলিশ কেন অতর্কিতভাবে গুলি চালালো তা আমার বুঝে আসে না।’
গুলিবিদ্ধ আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সব সময় যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি সাধারণ শিক্ষার্থীরাই হয়। আমরা পড়াশোনার জন্য ক্যাম্পাসে এসেছি। আমাদের ওপর এভাবে চড়াও হবে আমরা কখনো ভাবিনি। তবে যেটা হয়ে গেছে সেটা আমাদের শিক্ষকরা দেখবেন। আমাদের আকুল আবেদন থাকবে, আমাদের চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার যেন প্রশাসন দেখে। কারণ আমার পায়ের যে ব্যথা তা অসহনীয়। আমাদের শরীর ও পায়ের মধ্যে যে স্প্লিন্টার আছে তা বের না করা পর্যন্ত আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।
আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রশাসন দেখবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার নিশ্চিত করেছেন। কোনো শিক্ষার্থীর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাকে ঢাকায় পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
মেডিকেলে শিক্ষার্থীদেরকে দেখাশোনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা এম তারেক নূর। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আমরা আহত শিক্ষার্থীদের সবসময় খোঁজ-খবর রাখছি। তাদের চিকিৎসা সকল ব্যয়ভার আমরা বহন করছি। তাদের মধ্যে যারা গুরুতর আহত তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাচ্ছি আজ। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য স্যার তাদের কাছে এসে দেখে গেছেন।