শহীদ জোহা দিবস আজ
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি। ড. শহীদ সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা দিবস। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে নিজ ক্যাম্পাসেই নিহত হন। তিনিই দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। তার আগে কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবী এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ হওয়ার উদাহরণ নেই। দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিসহ আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসে ওঠা রাবি ছাত্রদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই শহীদ বুদ্ধিজীবী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণায় পাক-বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে শিক্ষার্থীরা এ ধারা উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন বড় হতে থাকে। এ সংবাদে তৎকালীন প্রক্টর ড. জোহা প্রধান ফটকে ছুটে যান।
প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্ররা পিছু হটতে নারাজ। তখন কোনো উপায়ান্তর না দেখে বেলা ১১টার দিকে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেন। ড. জোহা পাক বাহিনীর উদ্দেশ্যে তখন বলেন, ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার গায়ে যেন গুলি লাগে’। ছাত্রদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এভাবে চিৎকার করেছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। পাক বাহিনী ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে সেনাবাহিনীর ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মিউনিসিপ্যাল অফিসে। সেখানে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে দীর্ঘসময় অবহেলায় ফেলে রাখা হয়। পরে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪টার দিকে তাঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অপারেশন বেডেই এই মহান শিক্ষক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ড. জোহার মৃত্যুর ঘটনা সে সময় দেশের চলমান আন্দোলনকে এনে দেয় দুর্বার গতি। তৎকালীন সরকার উপায়ান্তর না দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তবে দুঃখের বিষয়, শহীদ ড. জোহার আত্মত্যাগের অর্ধশত বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত এ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি সরকার।
মৃত্যুর পরে মহান এই শিক্ষককে সমাহিত করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে। যা এখন জোহা চত্বর নামে পরিচিত। এছাড়া শহীদ ড. জোহাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি হলের নামকরণ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল। এই দিনটিকে ড. জোহা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিবসটি পালনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ড. শামসুজ্জোহা। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৮ সালে বাকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১ম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে ক্রিশ্চান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৪ সালে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে অর্ডিন্যান্স কারখানায় শিক্ষানবিশ সহকারী কারখানা পরিচালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার সময় তিনি স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান।