বিতর্কিতদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন জাবি ভিসি!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিভিন্ন দায়িত্বে বিতর্কিতদের পদায়ন করার অভিযোগ তুলেছে খোদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা। একইসঙ্গে ছাত্রদল ও বিএনপি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সাথে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নারী কেলেঙ্কারি, প্রশ্নফাঁস, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি, দুর্নীতি, শিক্ষক লাঞ্ছনার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ক্ষুব্ধ করে তুলেছে শিক্ষকদের।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পান অধ্যাপক নূরুল আলম। দায়িত্ব পাওয়ার চারমাসের মধ্যে সহকারী প্রক্টর, প্রক্টর, প্রভোস্ট, পরিবহন পরিচালক, ডিন, সিন্ডিকেট ও উপ-উপাচার্য পদে বিতর্কিত শিক্ষকদের পদায়ন ও সুপারিশ করেছেন তিনি। দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগে বাধ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের প্রভাবকেই চলমান অনিয়মের কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এবছরের ২৬ এপ্রিল পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনিকে সহকারী প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে বর্তমান প্রশাসনের বিতর্কিত কর্মকান্ডের যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষক পেটানোর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীকে শিক্ষক বানানোর প্রলোভনে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে গত ৬ নভেম্বর প্রশ্নফাঁসকারী হিসেবে অভিযুক্ত সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ উল হাসানকে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১১ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক হন তিনি। পরে ২০১২ সালে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে সহকারী প্রক্টর থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এছাড়া ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হয় লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান। যার বিরুদ্ধে গবেষণা প্রকাশনায় চৌর্যবৃত্তির প্রমাণ পাওয়ায় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে ইউজিসি গঠিত তদন্ত কমিটি। অধ্যাপক নূরুল আলম অঞ্চলপ্রীতি দেখিয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পরিবহন কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন তাকে, যেখানে অতিরিক্ত ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে তার জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক লুৎফুর এলাহী কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ২২ নম্বর হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব দেন উপাচার্য।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার মাস ধরে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদ শূন্য রয়েছে। এ পদে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদারের নাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে অজিত কুমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সিনেট অধিবেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের লুটতরাজকারী ও নারী নিপীড়নকারী হিসেবে মন্তব্য করে বিতর্কিত হন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নিজ স্বার্থে একাধিকবার দল পরিবর্তন ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে দুই আওয়ামীপন্থী উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং তাদেরকে উৎখাত করার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া উপ-উপাচার্য পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আরও দুইজনের নাম পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাাসন। তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। এদের মধ্যে অধ্যাপক বশির আহমেদের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সাবেক ভিপি আলমগীর হোসেন।
এছাড়া তিনি সিলেকশন বোর্ডের সদস্য সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগমের নোট অব ডিসেন্ট থাকা সত্ত্বেও ‘ক্ষমতার জোরে’ অধ্যাপক পদে পদন্নোতি পান বলে জানা গেছে। বশির আহমেদ প্রশাসনে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের বিরোধিতা ও বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের পুনর্বাসন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম উপাচার্য থাকাকালীন বশির আহমেদ বিভিন্ন অনিয়মের প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক বশির আহমেদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন ,আমি কখনোই ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না।
অন্যদিকে অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ভর্তি পরীক্ষা এবং স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর বিভিন্ন পর্বে পরীক্ষা কমিটি গঠনে পক্ষপাতদুষ্টতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ট শিক্ষক অধ্যাপক মফিজুল কবির টানা তিনবার ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অপেক্ষমাণ তালিকা প্রণয়নে জালিয়াতির অভিযোগ করে প্রশাসনের কাছে চিঠি দেন নাজিয়া জামান নামে এক শিক্ষার্থী। পরে প্রশাসন ওই বিভাগে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি স্থগিত করেন।
এছাড়াও বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে প্রভাব খাটিয়ে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে নিজেই একই শিক্ষাবর্ষে তিনবার ২য়, ৩য় ও ৪র্থ স্নাতক (সম্মান) পর্বে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিএনপিপন্থি এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার খাতা নিজে মূল্যায়ন না করে অন্য শিক্ষক দিয়ে মূল্যায়ন করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, এই অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। হঠাৎ করে কোথা থেকে এ ধরনের অভিযোগ আসছে তাও জানিনা।
এদিকে গবেষণা প্রকাশনায় স্বচ্ছতা ও নীতিনিষ্ঠতায় অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক মো. নুহু আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা তাকে এবিষয়ে তিরস্কার ও সতর্ক করেন। এছাড়া একাডেকিক সভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজের প্রভাব খাটিয়ে দুইজন প্রভাষককে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। যার একজনের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের একজন সাবেক নেতা বলেন, বর্তমান উপাচার্য অনিয়মকারী ও দুর্নীতিবাজদের তল্পিবাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরে বিতর্কিত ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযুক্ত শিক্ষকদের পদায়নের মাধ্যমে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। এটা আমাদের কাছে রীতিমতো অভাবনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, যাদের নাম প্রস্তাব করেছি তারা নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত গোপন রাখবো। এছাড়া অতিরিক্ত মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।