বাকি দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না ক্যান্টিন মালিক শফি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের কাছে বাকিতে খাবার বিক্রি করে আর কুলিয়ে উঠছেন না ক্যান্টিন মালিক শফি। শিক্ষার্থীদের কাছে এতো পরিমারণ টাকা জমেছে—তিনি বাধ্য হয়ে আর বাকি বিক্রি করবেনা না বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। একইসঙ্গে বাকি টাকা পরিশোধ করতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেছেন ‘‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। আমার চলতে কষ্ট হয়, আমাকে ক্যান্টিন চালাতে সহযোগিতা করুন, বাকির খাতা পরিশোধ করুন।’’
ক্যাম্পাসে সজ্জন ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিতি রয়েছে শফির। শিক্ষার্থীদের পকেটে টাকা না থাকলে খাবারের জন্য তিনিই ছিলেন শেষ ভরসা। তিনি টাকা না থাকলে কোনোদিন খাবার দিতে নিষেধ করেননি। আর এখন শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস করে বিরূপ প্রতিদান পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের এ ক্যান্টিন মালিক।
জানা যায়, হাজার হাজার টাকা বাকি রেখে অনেকে আর তা পরিশোধ করছেন না। অনেকে আবার টাকা পরিশোধ না করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে ক্যান্টিন তো দূরে থাক, সংসার চালানো তার কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা বাধ্য হয়ে এমন নোটিশ দিয়েছেন তিনি।
শফি বলেন, আমি আর পারছি না। সংসার আর ক্যান্টিন চালানো আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। যাদেরকে আমি নিজের ছোট ভাই মনে করে দিনের পর দিন বাকিতে খাইয়েছি—তারা এখন টাকা দিচ্ছে না। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, আমার ক্যান্টিনে অনেকে ৫ হাজারের বেশি টাকাও বাকি খেয়েছে। তাদেরকে টাকার কথা বললে নানা অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে চলে। আমি এ বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ স্যার ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুকে জানিয়েছি। তারা বকেয়া টাকা উত্তোলনে আমাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
এমন করুন অবস্থা শুধু বঙ্গবন্ধু হলের ক্যান্টিনের মালিক শফির একার না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব কয়টা হলের ক্যান্টিন, ক্যাম্পাসের খাবারের দোকান আর চায়ের দোকানের চিত্র এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এমনটা কখনো আশা করে না ক্যাম্পাসের এইসব দোকানীরা।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের বাকি দিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নিঃস্ব বহু দোকানি
ডিন কমপ্লেক্সের সামনে চা দোকানদার লিটন বলেন, আমরা এমনিতেই অল্প পুঁজির ব্যবসা। এর মধ্যে যদি আবার বেশি পরিমাণে বাকি দিয়ে ফেলি তবে ব্যবসার কিছু থাকে না। অনেক সময় অনেকে অল্প পরিমাণে বাকি নিলেও পরে তা দিতে চায় না। নানা ধরনের অজুহাত দেখায়। এ কারণে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে বাকি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
আরও পড়ুন: বাকি খেয়ে টাকা দেননি ছাত্ররা, নিঃস্ব হয়ে চবি ছাড়লেন অলিম
ক্যাম্পাসে ব্যবসা করা এসব দোকানীদের করুন চিত্র দেখে হতবাক শিক্ষার্থীদের একাংশ। তারাও ব্যাপারটা অবগত ছিলেন না। শিক্ষার্থীদের কাছে বাকি দিতে দিতে দোকানীরা অনেকটা গোপনে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলেন। মাঈনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যখন ক্যান্টিনে খেতে যাই; তখন কিন্তু মামাদের কাছে বাকির এমন লম্বা তালিকার কথা কখনো শুনিনি।
‘‘এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও কিছু মানুষের ফ্রি খাওয়ার প্রবৃত্তির কারণে আমাদের আপন মানুষগুলো ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।’’
ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আকরাম খান বলেন, টাকা না থাকলে একজন শিক্ষার্থী বাকি খেতেই পারে। আমরাও খেয়ে থাকি। তাই বলে বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ না করাটা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কাছে কখনো কাম্য নয়। এমন হতে থাকলে শিক্ষার্থীদের উপর দোকানীদের বিশ্বাস উঠে যাবে। পরে তারা বাধ্য হয়ে বাকি দেয়া বন্ধ করে দেবে।
অনেকটা তাই হয়েছে। একাধিক দোকানী ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের বাকি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের এ ক্যান্টিন মালিক শফি বাকি টাকা পরিশোধ করতে ও বন্ধে নোটিশ দিয়েছেন। এছাড়া আরও একাধিক দোকানী বাকি দেয়া বন্ধ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী একাডেমিক ভবনের সামনের দোকানদার রবি বলেন, আমার দুই টাকা আয়ের মধ্যে যদি এক টাকা বাকি দেই তাহলে আমার সংসার কেমন করে চলবে। ছোট ছেলে ইন্টার পরীক্ষা দিলো আর বড় ছেলে অনার্সে পড়ছে। তাদের সব খরচ এই চায়ের দোকান থেকে চলে। বাকি দিয়ে দেখেছি, পরে এটা টাকা উঠানো যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আমিও বাকি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
এদিকে, শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসের দোকানীদের এমন সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে রাজি নয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম বলেন, ক্যান্টিন পরিচালনার সঙ্গে কর্তৃপক্ষ জড়িত নয়। কিভাবে ক্যান্টিন চালাবেন সেটা মালিকের একান্ত বিষয়। হলে কোনো সাবসিডি (ভর্তুকি) দেওয়া হয় না। তাই হল কর্তৃপক্ষ এখানে কোনো ধরনের ইন্টারফেয়ারও করে না। শিক্ষার্থীরা বাকি খায়, দোকানীরা দেয়। তাদের নিজেদের বিষয়টি সমন্বয় করে নেওয়া উচিৎ।