পেরেকে জর্জরিত রাবির হাজারো গাছ, কমছে আয়ু
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। গাছপালা অক্সিজেন নিতে সাহায্য করে। কিন্তু প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পেরেক ঠুকে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করার প্রতিযোগিতা চলছে। এ রকম অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি)। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে গাছগুলো এখন পেরেক বিদ্ধ হয়ে ধুকছে। পরিবেশবিদদের মতে, পেরেকের আঘাতে গাছে ছিদ্র হয়। সেই ছিদ্র দিয়ে পচা পানি, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব প্রবেশ করায়স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে গাছগুলোর।
গাছে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড-বিজ্ঞাপন লাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছগুলোয় পেরেক ঠুকে লাগানো হয়েছে শত-শত ব্যানার ও পোস্টার। এ নিয়ে প্রশাসনকেও কোনো উদ্দ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
সরেজমিনে দেখে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট, কাজলা গেইট, প্যারিস রোড, টুকিটাকি চত্বর, পরিবহন মার্কেট, হলগুলোর সামনে, বিনোদপুর ও রেলস্টেশনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছগুলোতে পেরেক ঠুকে ঝুলানো হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের প্রচার-প্রচারণার সাইনবোর্ড-ব্যানার, ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন। তাতে পিছিয়ে নেই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলোর প্রচারণাও। দেখা মনে হবে, একেকটি গাছ বিজ্ঞাপন বোর্ড।
গাছে পেরেক ঠুকে সাইনবোর্ড না লাগানোর বিষয়ে ২০০২ সালের ৭ জুলাই জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। কিন্তু তা শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে নেই এর কোনো প্রয়োগ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ছিদ্র দিয়ে পানি এবং বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব প্রবেশ করায় গাছগুলোয় পচন ধরে। এতে খাদ্য ও পানি শোষণপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে গাছগুলো মারা যেতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছ লাগানো এবং গাছের পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তবে রাবিতে উল্টো গাছের ক্ষতি করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা: মেধা আর অর্থ দুটোরই অপচয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাকারিয়া সোহাগ বলেন, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। এভাবে রাজনৈতিক দলের প্রচারণা বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের জন্য গাছ ব্যবহার করা বন্ধ করতে দেশে আইন আছে। তাই কোনোভাবেই গাছে পেরেক ঠোকা যাবে না। একান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে গাছের গায়ে তার বা রশি দিয়ে তা বেঁধে ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো যেতে পারে।
রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ছাত্র সংগঠনের যে ব্যানারগুলো পেরেক ঠুকে গাছে লাগানো হয়েছে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পুরো পরিবেশের ওপর পড়ছে। সচেতন শিক্ষার্থী হয়ে যদি আমরা এমন কর্মকান্ড করি তাহলে অন্যদেরকে আমরা কি শেখাবো। ক্যাম্পাসের গাছগুলোতে এখনো পেরেক ঠুকে ব্যানার লাগানো হচ্ছে কিন্তু প্রশাসন কোনো উদ্দ্যোগ নিচ্ছে না। অতিদ্রুত প্রশাসন এ বিষয়ে নজর দেবে বলে আশা করি।
ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যকার মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, গাছে পেরেক মারা কেবল আইনের ব্যত্যয় নয়, এটি গাছকে ধ্বংস করার একটি চেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। দেশ তাদেরকে অনুসরণ করে। শিক্ষিত মানুষরা হয়ে যদি আমরা এসব কাজ করি, তাহলে সারা দেশে যে বৃক্ষ নিধন চলছে তাদেরকে কীভাবে সচেতন করব? গাছে পেরেক মারার ফলে আয়ু কমে যায়। সব থেকে চিন্তার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় গাছ নিধনের এমন প্রকাশ্য চেষ্টা চলছে।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন বলেন, গাছ আমাদেরকে অক্সিজেন নিতে সাহায্য করে। গাছে পেরেক ঠোকা মানে ও গাছ আর স্থায়ী হতে পারে না। ক্যাম্পাসের অনেক গাছ দিন দিন মারা যাচ্ছে। গাছে পেরেক মারা হলে গাছ মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এক পর্যায়ে গাছগুলোকে মারা যেতেও দেখা যায়। গাছকে হত্যা করা মানে পরিবেশকে হত্যা করার সামিল। সমাজের পরিবেশ রক্ষার্থে গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের সকলের উচিত ধ্বংস না করে গাছ লাগানো।
আরো পড়ুন: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রাজশাহী জেলার সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, গাছের জীবনকে নষ্ট করার অধিকার কোনো ব্যক্তির নেই। এখানে সচেতনতার বড় অভাব রয়েছে। সরকার আইন করেছে কিন্তু আইনকে যারা বাস্তবায়ন করবে তারা সঠিকভাবে সেটা পালন করছে না। কোনোভাবেই এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে যদি সকলকে সচেতন করা যায় তাহলে আগামী দিনে গাছ নিধন কমে আসবে তিনি মনে করেন।
প্রশাসনের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা এম তারেক নূর বলেন, গাছে পেরেক ঠুকে পোস্টার-ব্যানার টাঙ্গানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার একটি আইন পাস করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রশাসন থেকে উদ্দ্যোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের সকল গাছ থেকে পোস্টার-ব্যানার নামানোর জন্য আমরা অভিযান চালিয়েছিলাম। আবারও বিশেষ অভিযান চালাবো। তারপরও যদি কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা সংস্থা এ কাজটি অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা চাই প্রতিটি গাছ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠুক। গাছের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য তিনি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের আহ্বান জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হক বলেন, নীরবে গাছ আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গাছের জন্যই বেশি পরিচিত। আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ করছি গাছে পেরেক ঠুকে ব্যানার ফেস্টুন লাগানোর ফলে গাছের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এমন কর্মকান্ড থেকে উঠে আসার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি পেরেকের পরিবর্তে বাঁশ, রশ্মি ব্যবহারে নির্দেশ দিবো আমরা। ক্যাম্পাসে পেরেক ঠোকে যেসব ব্যানার লাগানো হয়েছে তা সরিয়ে ফেলার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।