রাবিতে খেলাধুলা: সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে সংঘর্ষে!
খেলাধুলা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পারস্পরিক সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। তাই বছরজুড়ে থাকে বিভিন্ন খেলাধুলার আমেজ। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চলা আন্তঃবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি সম্প্রীতি বৃদ্ধির উদ্দ্যেশ্যে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় পরপর সংঘর্ষের ঘটনায় সম্প্রীতি বরং হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
ফুটবল মাঠে খেলা পরিচালকের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক, গ্যালারিতে উভয় পক্ষের মধ্যে মারামারি ও ভাঙচুর, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশাসনের নির্দেশনা না মানাসহ- এমন অনেক ঘটনা পুরো টুর্নামেন্টকে করে তুলেছে বিতর্কিত। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে- এই খেলা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করছে নাকি প্রতিহিংসা শিক্ষা দিচ্ছে। এমনকি তাদের এমন আচরণ সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাবোধের চরম অবক্ষয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) এবং ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোইজুর রহমানকে শারীরিক লাঞ্ছিত করার অভিযোগে আইবিএ শিক্ষার্থী ও সেই ইনিস্টিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সিনহাকে তদন্ত সাপেক্ষে সাময়িক বহিস্কার করা হয়। তবে তাকে স্থায়ী বহিস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন ভেটেরিনারি এণ্ড এনিমেল সাইন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষার্থীরাই আগে ঝামেলার সৃষ্টি করেছে এবং তাদের শিক্ষককের গায়ে হাত তুলেছেন বলে অভিযোগ তোলেন আইবিএ’র শিক্ষার্থীরা। এমনকি তাদের শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে বেশ কয়েকদিন আন্দোলনও করেন তারা।
এদিকে এ ঘটনার চারদিন পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর খেলায় রেফারি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। সেই ঝামেলা থামাতে গিয়ে আহত হন প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। যদিও আহত হওয়ার বিষয়টি দুর্ঘটনা ছিল বলে জানিয়েছেন প্রক্টর।
আরো পড়ুন: রিজভী ‘উপাচার্য ও প্রক্টরকে’ অশালীন ভাষায় হুমকি দিয়েছেন
এছাড়া গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ এবং ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের মধ্যে অনুষ্ঠিত খেলায় গোল বিতর্কের জেরে উভয় বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি ঘটনা ঘটে। এমনকি প্রায় দিনই খেলার মাঠে অপরপক্ষে সমর্থকদের বিভিন্ন ভাষায় আক্রমন করা, রেফারির সিদ্ধান্ত না মেনে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে খেলা নিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
খেলাকে কেন্দ্র করে এমন বিশৃঙ্খলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে মনে করছেন শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, খেলার মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু এখন এই খেলায় শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের হতাহত হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় কাম্য নয়। এসব ঘটনা জাতির কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করছে। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা সবার থাকতে হবে। এটাও একটা শিক্ষা। তাছাড়া খেলার মাঠে অপরপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা চরমভাবে অবনতি লক্ষণীয়। যা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষার্থীরা।
অনেকের অভিযোগ, খেলা রেফারির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই বেশি বিতর্কিত হচ্ছে। এমনকি টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে অবহেলা ও নিরাপত্তাজনিত ত্রুটিই এমন বিশৃঙ্খলা জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন ঘটনা নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। অন্যদিকে এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তির সৃষ্টি করছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাছাড়া ক্যাম্পাসে যেকোন ধরণের বিশৃঙ্খলারোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা, দোষীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা, খেলার মাঠে স্ব স্ব বিভাগের শিক্ষকের উপস্থিত এবং কোন বিতর্কিত ঘটনা ঘটলে তা উভয়পক্ষের শিক্ষক মিলে যৌথ আলোচনায় সমাধান করা, খেলা পরিচালনা কমিটির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, কোন বিতর্কিত ঘটনার তাৎক্ষণাৎ সমাধান না হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানো- এসব বিষয় নিশ্চিত করলে খেলা কেন্দ্রিক পারস্পারিক বিশৃঙ্খলারোধ করা সম্ভব হবে।
আরো পড়ুন: চবিতে সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
বিতর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের সদস্য সচিব ওহেদুন নবী বলেন, মাঠে বিতর্ক সৃষ্টির মূল কারণ শিক্ষার্থীরা খেলার আইন সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত না থাকা এবং পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা প্রস্তুত না থাকা। বিগত সময়গুলোতে খেলা হয়েছে এবং সেখানেও ছোটখাটো বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এত বেশি বিতর্ক ছিল না।
রেফারির নিরপেক্ষতার বিষয়ে এ সচিব বলেন, কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়। খেলার মাঠে ছোটখাটো ভুল হয় এবং সেটা আলোচনা সাপেক্ষে সমাধানও হয়। তবে রেফারি যথেষ্ট নিরপেক্ষ থাকে। তারপরেও যদি গুরুতর সমস্যা হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে, তারা বিষয়টি দেখবে। কিন্তু এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাঙচুর কিংবা মারামারি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তবে খেলা শিক্ষার একটা অংশ। তাই সবকিছু ছাপিয়ে খেলাধুলা চলবে। তবে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত খেলার মাঠে কোনো না কোনো বিষয়ে বিতর্কে জড়াচ্ছে। তারা শিক্ষক কিংবা প্রশাসনের কথা মানছে না। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের হার মেনে নেয়ার মানসিকতা খুবই কম। একইসাথে তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্প্রীতি রক্ষার মানসিকতাও কমে গেছে। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যেই হোক না কেন তাকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রামাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, মাঠে যে বিভাগের খেলা অনুষ্ঠিত হবে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের সংযত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। মাঠে বিতর্কিত কিছু ঘটলে শিক্ষকসহ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। তাহলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন প্রক্টর।