রুয়েট উপাচার্যের শ্যালক-ভাইবোন-গৃহকর্মী নিয়োগ অবৈধ
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। সেই অভিযোগ অনুসন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়টির গোটা নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে আরো বেশকিছু গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা গেছে। সকল অনিয়ম উল্লেখিত প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার (৮ আগস্ট) ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ইউজিসির তদন্ত কার্যক্রম চলমান অবস্থায় গত ৩০ জুলাই উপাচার্য পদে মেয়াদ শেষ হয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখর।
চলতি বছরের শুরুর দিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাধিক আত্মীয়- ভাইবোন, শ্যালক, গৃহকর্মী ও গৃহকর্মীর স্বামীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠে। গত ২০ মার্চ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় ইউজিসিকে। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ খুঁজতে গিয়ে আরো বেশকিছু বিষয় উঠে আসে ইউজিসির তদন্ত কমিটির সামনে। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপাচার্যের অধীনে গোটা নিয়োগ কার্যক্রমের বৈধ্যতার বিষয়টি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই চার বছরের জন্য রুয়েটের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। নিয়োগ পাওয়ার পরের বছর তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রুয়েটে বিভিন্ন পদে ১৩৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। আর নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয় গত বছরের ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২তম সিন্ডিকেট সভায়। নিয়োগ অনুমোদনের পর অভিযোগ ওঠে, উপাচার্য স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে তার ভাই মো: মুকুল হোসেনকে ‘সেকশন অফিসার’, আরেক ভাই লেবারুল ইসলামকে ‘জুনিয়র সেকশন অফিসার’, শ্যালক সোহেল আহমেদকে ‘পিএ টু ডিরেক্টর’, চাচাতো বোন মাছুমা খাতুনকে ‘ডাটা এন্ট্রি অপারেটর’, গৃহকর্মী লাভলী আরাকে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট কুক’, গৃহকর্মী লাভলীর স্বামী এনামুল হককে ‘উপাচার্যের গাড়িচালক’ এবং স্ত্রীর ফুফাতো ভাই মেহেদী হাসানকে ‘কেয়ারটেকার’ পদে নিয়োগ দেন। এছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে বেশি জনবল নিয়োগ দেয়ারও অভিযোগ ওঠে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের চীনে ফেরার নিয়ম জানাল দূতাবাস
বিশ্ববিদ্যালয়টির সংবিধি অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটির সভাপতি হবেন উপাচার্য। তবে বহুল প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রার্থীদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন থাকলে উপাচার্য তা র সভাপতি পদ থেকে ঘোষণা দিয়ে সিন্ডিকেটের অনমোদন নিয়ে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে তার দায়িত্বে নিয়োগ দেবেন এবং তারপর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
এক্ষেত্রে উপাচার্যের আত্মীয়স্বজনদের যে বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়, তার প্রধান করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারকে কিন্তু দায়িত্বভার প্রদানের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের অনুমোদিত নয় বলে জানা গেছে। যেহেতু নিয়োগ বোর্ডটি আইনসম্মত উপায়ে গঠিত হয়নি, সেহেতু ওই বোর্ড পরিচালিত নিয়োগ কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।
রেজিস্ট্রারকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান করার বাইরেও এসংক্রান্ত আরো বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্যবিদায়ী উপাচার্যের মেয়াদে দেয়া ওই নিয়োগ কার্যক্রমের সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও এমপিকিউর (ন্যূনতম নির্ধারিত যোগ্যতা) বাইরে গিয়ে অনেককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগপত্র ইস্যু করার সময় যে রেজিস্ট্রারে তথ্য সংরক্ষণের কথা, সেখানে নিয়োগপ্রাপ্তদের কোনো নাম বা পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া যে সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়, সে সভার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যদের সভার কার্যবিবরণী জানানো এবং অনুমোদনের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। বরং এক বছর পরে কয়েকটি সিন্ডিকেট সভার পর সেটি সিন্ডিকেট সদস্যদের জানানো হয়। এছাড়া নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় নানা ধরনের ঘষামাজা ও অসংগতির তথ্যও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
নিয়োগ কার্যক্রমে উঠে আসা এসব অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উপাচার্যসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অনিয়মে জড়িত থাকায় রুয়েটের রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ঘোষণা দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে নিয়ম মেনে অন্য কাউকে নিয়োগ করেন। এমনকি ক্লাসেও কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে সংশ্লিষ্ট কোর্সের প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নৈতিক প্রচলন রয়েছে। এখন যা দেখছি বা শুনছি, তা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক।
এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ কার্যক্রমে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম করার অভিযোগ উঠেছে ও প্রমাণ মিলেছে।