০২ অক্টোবর ২০২৫, ২০:১০

অগ্রিম সমন্বয় করেনি ইউজিসি ও ২১ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার অনিয়ম

ইউজিসি ভবন ও লোগো  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং এর অধীনস্থ ২১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। এ অর্থ বছরের পর বছর ধরে সমন্বয় না করায় বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সময়কালে এই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন দাপ্তরিক খাতে ব্যয়ের জন্য অগ্রিম দেওয়া হয়। তবে অগ্রিম দেওয়া অর্থেরর অধিকাংশই এখনো সমন্বয় না হওয়ায় বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিউটি খাতুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’

২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় নিরীক্ষার জবাবে কোনো ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেনি, যা অডিট কোডের বিধি ৫৯ এবং ট্রেজারি রুলস অনুসারে প্রণীত সাবসিডিয়ারি রুলস-এর বিধি ৪৩৭ লঙ্ঘনের সামিল। এছাড়া যেসব বিশ্ববিদ্যালয় জবাব দিয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয়। ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক জবাব দিলেও তা নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সভা, প্রশিক্ষণ, পরীক্ষাসংক্রান্ত ব্যয়, দাপ্তরিক কেনাকাটা, মেরামত, জ্বালানি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কেনাকাটার জন্য ইউজিসি এবং এর অধীন ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪৬ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ১৮৩ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। বিএসআর-এর ২৯৮ নম্বর বিধি এবং ইউজিসির পরিপত্র অনুযায়ী, অগ্রিম গ্রহণের ছয় মাস বা অর্থ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এসব অর্থের সমন্বয় বাধ্যতামূলক ছিল। তবে এই সময়সীমার মধ্যে প্রদত্ত অগ্রিম সমন্বয় করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

নিরীক্ষা দল জানিয়েছে, ২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় নিরীক্ষার জবাবে কোনো ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেনি, যা অডিট কোডের বিধি ৫৯ এবং ট্রেজারি রুলস অনুসারে প্রণীত সাবসিডিয়ারি রুলস-এর বিধি ৪৩৭ লঙ্ঘনের সামিল। এছাড়া যেসব বিশ্ববিদ্যালয় জবাব দিয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয়। ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক জবাব দিলেও তা নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউজিসি ও কয়কটি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, অগ্রিম দেওয়া অর্থ সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলছে, আবার কেউ জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে অথবা ভবিষ্যতে সমন্বয় করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, কাজের প্রকৃতি ও সময়ের কারণে সমন্বয়ে বিলম্ব হচ্ছে। কেউ কেউ আবার পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত জবাব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। যদিও কিন্তু নিরীক্ষা দল জানিয়েছে, জিএফআর-এর বিধি ২৬২ অনুসারে নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম করায় এসব ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।

নিরীক্ষকরা বলছেন, অগ্রিম অর্থ আদায় বা খরচের সঠিক প্রমাণপত্র ছাড়া বছরের পর বছর অর্থ আটকে থাকলে এটি বাজেট ব্যবস্থাপনায় গলদ এবং সরকারি অর্থ ব্যবহারে জবাবদিহির অভাবকে প্রকাশ করে।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি টাকা অগ্রিম দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সব ২০ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭৩ টাকা অগ্রিম দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৯১ হাজার ৫৬৫, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ৭৪ লাখ ২৫ হাজার ৫৫৮, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দুই কোটি ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৩৮৬, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দুই কোটি ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২২ লাখ ৯১ হাজার ৩৩৩ টাকা অগ্রিম দিয়েছে।

ইউজিসি কী বলছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিজেও ৬ লাখ ২২ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ২ লাখ টাকা সমন্বয় সম্পন্ন করেছে। অবশিষ্ট অর্থ আদায়ের পর সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে ইউজিসির অডিট শাখার পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নাহিদ সুলতানা দ্য ডেইলি ক্যাম্পোসকে বলেন, ‘যে সকল বিষয়ে আপত্তি এসেছে, কমিশন সে সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের কাছে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বা মতামত নিয়েছি। সেগুলো রিপোর্ট আকারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হবে।’

তদারক সংস্থা ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসার দাবি উঠেছে। আর্থিক অনিয়ম ও বিধিভঙ্গের ফলে সরকারের তহবিল ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি ক্রয়বিধি উপেক্ষা করে এসব ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কমে যায়। এছাড়া, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম প্রতিরোধে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ও স্বচ্ছ মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

কোন বিশ্ববিদ্যালয় কত টাকা অগ্রিম দিয়েছে?
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি টাকা অগ্রিম দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সব ২০ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭৩ টাকা অগ্রিম দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৯১ হাজার ৫৬৫, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ৭৪ লাখ ২৫ হাজার ৫৫৮, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দুই কোটি ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৩৮৬, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দুই কোটি ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২২ লাখ ৯১ হাজার ৩৩৩ টাকা অগ্রিম দিয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অগ্রিম দিয়েছে ৬ লাখ ২২ হাজার ১৬৭, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৮ লাখ ৪৪ হাজার ১২০, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ লাখ দুই হাজার ৫৫৯, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭ লাখ ২০ হাজার ৯০৮, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ১০ লাখ ৩ হাজার ৮৮০, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৮৫ লাখ ৫২ হাজার ২২৭, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়৭ লাখ ১৫ হাজার, গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি এক লাখ ৭৮ হাজার ৬৬০, উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ৮০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৭০, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ লাখ ২২ হাজার ৪৭৮, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪১৫, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৬৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ লাখ ৮৪ হাজার ৫৯২, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছয় লাখ সাত হাজার ৮৮৬ এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪১ লাখ ৩০ হাজার ৩০ টাকা অগ্রিম দিয়েছে।